মিয়ানমারে প্রতিরোধ বাহিনীর অগ্রগতি, পতনের দ্বারপ্রান্তে জান্তা

নিউজ ডেস্ক
মিয়ানমারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গত বছর তিনটি সুসজ্জিত মিলিশিয়া গোষ্ঠী যৌথভাবে আকস্মিক আক্রমণ চালায়। এই হামলার পর সামরিক সরকারের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী কৌশলগত স্থবিরতা ভেঙে পড়েছে। বিশাল ভূখণ্ড তারা দ্রুত দখল করে। এতে দেশের অপর গোষ্ঠীগুলো জান্তার বিরুদ্ধে আক্রমণে উৎসাহিত হয়। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি এ খবর জানিয়েছে।
তাতমাদাও নামে পরিচিত সামরিক বাহিনী নিজেদের শক্তিশালী অবস্থানে বিবেচনা করে আসছিল। সেনা ও অস্ত্রে বিশালভাবে এগিয়ে থাকা এবং রাশিয়া ও চীনের সামরিক সরঞ্জাম পাওয়ার কারণে তাদের অবস্থান দৃঢ় বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু এখন সারা দেশে সরকারের বাহিনী ক্রমশ পিছু হটছে। বেশ কয়েকটি চৌকি, ঘাঁটি ও কৌশলগত শহর হারানোর পর সামরিক বাহিনী নেতৃস্থানীয় সদস্যরাও স্বীকার করছেন সেগুলো পুনরুদ্ধার করা কঠিন হবে।
অ্যাডভোকেসি গোষ্ঠী স্পেশাল অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমারের কনর ম্যাকডোনাল্ড বলেন, সারা দেশে সামরিক বাহিনী রক্ষণাত্মক নীতিতে চলে গেছে এবং তারা যখন এক অংশে সেনা মোতায়েন করে, অপর অংশ দুর্বল হয়ে পড়ে। আমাদের দৃষ্টিতে, সামরিক বাহিনীর হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের কোনও উপায় নেই।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখর করেছিল সেনাবাহিনী। এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াইরত জাতিগত গোষ্ঠীর মিলিশিয়াদের সঙ্গে সংঘর্ষ তীব্র হয়ে ওঠে। সামরিক শাসন শুরু হওয়ার পর গঠিত হয় গণতন্ত্রপন্থি পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস গঠিত হয়েছে। এই বাহিনী জাতীয় ঐক্য সরকারকে সমর্থন করে।
তবে ২৭ অক্টোবর শুরু হওয়া অপারেশন ১০২৭ পর্যন্ত তাতমাদাও দেশের সর্বত্র বড় ধরনের ক্ষতি রোধ করতে সক্ষম হয়েছিল। তিনটি শক্তিশালী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গড়ে তুলে। এগুলো হলো—মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, আরাকান আর্মি এবং তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি। তারা সমন্বিত আক্রমণ চালিয়ে চীনের সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্ব শান রাজ্যে অনেক শহর ও সামরিক ঘাঁটি দখল করে।
এক বছর পর প্রতিরোধ বাহিনী এখন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পশ্চিমের রাখাইন রাজ্য থেকে শুরু করে উত্তরে এবং দক্ষিণে কায়াহ ও কায়িন রাজ্যের বিশাল এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। তাতমাদাও মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চল, নেপিদো ও ইয়াঙ্গুন শহরের আশেপাশের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে।
তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির মুখপাত্র লওয়ে ইয়াই উ বলেন, আমি কখনও ভাবিনি যে আমাদের লক্ষ্য এত দ্রুত অর্জিত হবে। আমরা সামরিক পরিষদের বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব আক্রমণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আশানুরূপ সহজতায় সাফল্য পেয়েছি।
তাতমাদাও লাউক্কাই শহরে পরাজিত হয়েছে। সেখানে মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি দুই হাজারেরও বেশি সেনা সহ ছয়জন জেনারেলকে বন্দি করেছে। এছাড়া, লাশিও শহরও দখল করেছে তারা। যা সেনাবাহিনীর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দফতর ছিল।
সেনাবাহিনীর শক্তি ক্ষীণ হয়ে পড়েছে, তবে পরাজিত হয়নি। তারা সাগাইং অঞ্চলের কাওলিন শহর পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে এবং কায়াহ রাজ্যের রাজধানী লোইকাওতে আক্রমণ প্রতিরোধ করেছে। তাতমাদাও থাইল্যান্ডের সঙ্গে মূল সীমান্ত ক্রসিং মিয়াওয়াডি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
অনেকেই মনে করেন, বর্ষা মৌসুম শেষে সামরিক বাহিনী পাল্টা আক্রমণে যেতে পারে। কারণ তাদের বিমান শক্তি অটুট রয়েছে। সামরিক বাহিনীতে নতুন প্রায় ৩০ হাজার সেনা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তবে প্রতিরোধ বাহিনী ম্যান্ডালয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এটি মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। প্রতিরোধ বাহিনী গত এক বছরে অর্জিত সামরিক অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত।
এদিকে, সংঘর্ষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতির হার বেড়েছে। জাতিসংঘের তথ্য মতে, ১০২৭ অভিযান শুরু হওয়ার পর বিমান হামলায় বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা ৯৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গোলাবর্ষণে ১৭০ শতাংশের বেশি বেসামরিক প্রাণহানি ঘটেছে।
সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর অভিযোগ উঠেছে। তবে সামরিক বাহিনী এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে কয়েক লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। মিয়ানমারে এখন ৩০ লাখেরও বেশি অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ রয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিরোধ বাহিনীর সাফল্য নতুন সমস্যার ইঙ্গিত দিচ্ছে। জাতিগত এলাকাগুলো ছাড়িয়ে এখন মিলিশিয়া বাহিনী অন্যান্য অঞ্চলেও অগ্রসর হচ্ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে।
এছাড়া, প্রতিবেশী চীনের প্রভাবও জটিলতা সৃষ্টি করছে। চীন গত জানুয়ারিতে উত্তরের শান রাজ্যে সাময়িক যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করলেও জুন মাসে আবারও লড়াই শুরু হয়। চীন সামরিক বাহিনীকে সমর্থন বাড়াচ্ছে এবং সংঘর্ষ থামানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
জান্তাবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে। জাতীয় ঐক্য সরকারের মুখপাত্র কিয়াও জাও বলেন, কেউ আমাদের ওপর চাপ দিচ্ছে না। আমরা জনগণের শক্তির কারণে জয়ী হচ্ছি।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।