পাকুয়াখালী গণহত্যা দিবস আজ, বিচার পায়নি ক্ষতিগ্রস্থরা - Southeast Asia Journal

পাকুয়াখালী গণহত্যা দিবস আজ, বিচার পায়নি ক্ষতিগ্রস্থরা

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

ফিচার ডেস্ক

আজ পাকুয়াখালী ট্রাজেডি দিবস। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিহাসে শোকাবহ এক কালোদিন। ১৯৯৬ সালের এই দিনে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের প্রাক্কালে রাঙামাটির লংগদু উপজেলার পাকুয়াখালীর গহীন অরণ্যে তৎকালীন শান্তি বাহিনীর হাতে নির্মম ও বর্বরোচিতভাবে প্রাণ হারায় ৩৪ জন নিরীহ বাঙালী কাঠুরিয়া। সেই থেকে পার্বত্য এলাকায় বাঙ্গালীরা এ দিনটিকে পাকুয়াখালী ট্রাজেডি হিসেবে শোক দিবস পালন করে আসছে।

১৯৯৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপ শান্তি বাহিনী লংগদুর ৩৫ জন কাঠুরিয়াকে প্রতারণা করে ব্যবসায়িক হিসাবের কথা বলে পাকুয়াখালীর গহীন অরণ্যে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে তিন দিন কাঠুরিয়াদের হাত-পা ও চোখ বেঁধে নির্যাতন চালিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় ৩৪ জন কাঠুরিয়াকে। এর মধ্যে ইউনুচ নামের একজন কাঠুরিয়া পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। পরে ৯ সেপ্টেম্বর পুলিশ ও সেনাবাহিনী পাকুয়াখালী হতে ২৮ জন কাঠুরিয়ার ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে। বাকি ৬ জন কাঠুরিয়ার লাশ পাওয়া যায়নি।

বর্বর এ হত্যাকান্ডের স্মরণে এখনো শিউরে ওঠে লংগদুর মানুষ। হত্যাকান্ড থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরত আসা একমাত্র ব্যক্তি ইউনুছ তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘‘বাড়িতে আসার পর আর্মীরা যহন জানলো যে আমাকেও শান্তি বাহিনী ধরে নিয়া গিয়াছিল, তহন তারা লাশের সন্ধান করার জন্য আমাকেও সাথে নেয় পথ দেখানোর জন্য। আমি তাদের পাহাড়ে নিয়া গেলাম। ঘটনার সময় তক্তা নজরুলের যেইখানে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়া ফালাইয়া দিছিল, সেইখান থাইকা আরেকটু সামনে গিয়া দেখলাম, বাম দিকে প্রায় এক দেড়শ’ গজ সামনে গিয়া দেখলাম, একটা বাঁশের বেড়া। নীচে নাইমা সেই বেড়া পার হইলাম। তার পর আর রান্তার চিহ্ন নাই। একটু দূরে দেখলাম একটা কাঁচা বাঁশের কঞ্চি আধ ভাঙ্গা অবস্থায় ঝুইলা রইছে। কঞ্চিটা সরানোর পর একটা পথ পাইলাম। পথ দিয়া সামনে গিয়া দেখি সরাফুদ্দি ভাইয়ের টুপিটা একটা কঞ্চির লগে বাইজা রইছে। এর পর স্যান্ডেল, মদের টেংকি, বেশ কয়ডা লাডিও দেখলাম, তারপর দেখলাম আলাল ভাইয়ের লাশ। আরেকটু সামনে গিয়া দেখি বিশাল জায়গা জুইড়া শুধু লাশ আর লাশ কেউরে চেনা যায় না। বন্দুকের সামনের যে চাকুটা (বেয়োনেট) থাকে এইডা দিয়া খোঁচাইয়া খোঁচাইয়া মারছে। কেউরে চেনা যায় না। লাঠি দিয়া পিটাইয়া, দা দিয়া কুবাইয়া, কুইচ্যা মারার শিক দিয়া পারাইয়া, চোখ তুইলা, আরো কতোভাবে যে কষ্ট দিয়া মারছে তা কইয়া শেষ করন যাইবো না। ঐ কথা মনে হইলে আজো শরীরের পশম খারাইয়া যায়।’’

ইউনুছের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় এ হত্যাকান্ড কতটা পৈশাচিক ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত অনেকগুলো বড় ধরনের হত্যাকান্ডের মধ্যে বর্বরতম এ হত্যাকান্ডের প্রায় ২ যুগ অতিবাহিত হলেও এখনো এ ঘটনার বিচার হয়নি। যেন নিভৃতে কাঁদছে বিচারের বাণী।

১৯৯৬ সালে সংঘটিত এ হত্যাকান্ডের পর প্রতিবাদে উত্তাল রাঙামাটিতে এসে তৎকালীন সরকারের চার চারজন সিনিয়র মন্ত্রী নিহত কাঠুরিয়াদের লাশ সামনে নিয়ে জনতাকে এ হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কথা দিয়েছিলেন যোগ্য ক্ষতিপূরণ দেয়ারও। এর পর অতিক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২যুগ। নিহতদের পরিবার সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ পেলেও তা নিতান্তই কম। সে হত্যাকান্ডের মৃত্যুকূপ থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা ইউনুস তখনই বাদী হয়ে নিয়মিত মামলা রুজু করেছিলেন। মামলা হয়েছিল সরকারিভাবেও। তক্তা নজরুল থেকে শুরু করে নিহত কাঠুরিয়াদের স্বজনরা হত্যাকান্ডের বিচার না পেয়ে চরম হতাশায় দিনাতিপাত করছেন। অমানবিক জীবন যাপন করছে নিহত কাঠুরিয়াদের পরিবার পরিজন।

এ ঘটনার পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের একটি সংসদীয় টিম লংগদু সফর করে এ ঘটনার সুষ্ট তদন্ত ও দোষীদের বিচার, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের আশ্বাস দেয়। পরবর্তী সরকারগুলো একই আশ্বাস দিয়ে আসলেও এখনো এই নির্মম ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার কোন কুল কিনারা হয়নি এবং পুনর্বাসিত হয়নি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।

এদিকে দিবসটি স্মরণে এবারো বাঙ্গালীরা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। লংগদু উপজেলায় স্থানীয় বাঙ্গালীরা শহীদদের কবর জিয়ারত, শোক সভা ও দোয়া মাহফিল এবং পার্বত্য-বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে শহরে শোক সভা ও মিলাদ মাহফিল কর্মসূচি পালন করবে।