শান্তিবাহিনীর জন্ম  কি আসলেই যৌক্তিক ছিল?

শান্তিবাহিনীর জন্ম  কি আসলেই যৌক্তিক ছিল?

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

পারভেজ হায়দার

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি ভিত্তিক আঞ্চলিক দল পিসিজেএসএস (পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি) এৱ  সশস্ত্র অঙ্গ সংগঠন “শান্তিবাহিনী”র সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পট-পরিবর্তন ও মেরুকরণে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র কার্যক্রমের কারণে সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই ১৯৭৭-৭৮ সালে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়োজিত করা হয়েছিল। নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র কার্যক্রম দিনে দিনে যখন বেড়েই চলছিল, তখন এ অঞ্চলে বসবাসরত অধিবাসীদের সংখ্যা ভিত্তিক একটি সামঞ্জস্য সৃষ্টির জন্য তৎকালীন সরকার দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুসরণ করে সমতল ভূমির বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৪ লক্ষ দরিদ্র বাঙালী জনগোষ্ঠীকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানের খাস জমি থেকে পরিবারপ্রতি ৫ একর জমি বন্দোবস্তি দিয়ে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছিল। ইতিপূর্বে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাঙ্গালীদের আগমন ঘটেছে, বাঙ্গালীরা স্থানীয় পাহাড়ি অধিবাসীদের জীবনযাত্রা মানোন্নয়নের সহযোগিতা করেছে। তবে অন্য সময়ের চেয়ে এইবারের বাঙালীদের পরিকল্পিত আগমনের অন্যতম কারণ শান্তিবাহিনীর অনাকাঙ্খিত সন্ত্রাস। অর্থাৎ শান্তিবাহিনীর জন্মের কারণেই অধিক সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি এবং পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালীর বসতি গড়ে উঠেছিল। শান্তিবাহিনীর কার্যক্রমের কারণে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে এবং পরবর্তীতে পিসিজেএসএস’র সশস্ত্র ভূমিকার কারণে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, সাধারণ বাঙালি ও পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কেনই বা শান্তিবাহিনীর জন্ম হয়েছিল? কি এমন ঘটেছিল যে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত, ধ্বংসপ্রায় এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল একটি দেশের সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করতে একটি সশস্ত্র দল গঠনের প্রয়োজন পড়লো? পরিস্থিতি কি এমনই নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল যে সশস্ত্র সংগ্রাম এড়ানো যেত না?

ছবি-১: এমএন লারমা।

“শান্তি বাহিনী” যে দলের নামের অর্থ বিশ্লেষণ করলে শান্তি আনয়নের স্পৃহাকে বুঝায়, সেই দলই কি-না উপযুক্ত গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে দিল, যার বলি হলো হাজার হাজার নিরপরাধ বাঙালি, শত শত পাহাড়ি আর অসংখ্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত গ্রন্থ, সাময়িকী, সংবাদপত্র ও গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণে শান্তিবাহিনীর জন্মের সময়কার যেসব চিত্রটি ফুটে উঠে, সেসব মূলত একই ধরনের। অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নেতা এমএন লারমা, চারু বিকাশ চাকমা ও মং প্রু সেইনসহ কয়েকজন উপজাতি নেতৃবৃন্দের একটি দল ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে তৎকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে উপস্থিত হয়। এই উপজাতি দলটি কয়েকটি দাবি-দাওয়া নিয়ে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সাথেও সাক্ষাৎ করে। দাবিগুলো ছিল অনেকটা এরকম,

  • পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন ও নিজস্ব আইন পরিষদ বাস্তবায়ন।
  • সংবিধানে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের অনুরুপ বিধি অন্তর্ভুক্তি।
  • উপজাতি রাজার পদ সংরক্ষণ।
  • ১৯০০ সালের রেগুলেশন সংশোধনের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতি স্থাপন বন্ধকরণ।

সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের তৎকালীন নেতৃবৃন্দের কাছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর হঠাৎ এই দাবি একেবারেই অনাকাঙ্খিত ছিল। কারণ দূর অতীতের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বার্মা ও ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে প্রায় ১৩ ধরনের উপজাতি জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপনের পর থেকে কখনো স্বায়ত্বশাসন দাবি করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি উপজাতি জনগোষ্ঠীর বসবাস হলেও চাকমাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ইতিহাসের বিভিন্ন সময় অর্থাৎ, মোঘল আমল, ইংরেজ আমল কিংবা পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা ১৭৭৭ থেকে ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত চাকমাদের সাথে ব্রিপিশদের সংঘর্ষের ঐ সময় ব্যতীত সব আমলে নীতি-নির্ধারকদের সাথে সমন্বয় করে বসবাস করেছে।

ছবি-২: পিসিজএসএস’র বর্তমান সভাপতি সন্তু লারমা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর উপজাতি নেতৃবৃন্দের স্বায়ত্বশাসন সম্পর্কিত এবং বিশেষ অধিকার বিষয়ক চারটি দাবি তৎকালীন সরকার আমলে নেয়নি, এই অভিযোগ ছাড়াও আরও একটি অভিযোগ উপজাতি নেতৃবৃন্দ করে থাকেন। তারা দাবি করেন তৎকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু তাদের “বাঙালি” হয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ওই বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করে স্বার্থান্বেষী কিছু পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে চাইছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক দলিল ভিন্ন কথা বলে। ১৯৭৩ সালের নতুন সংবিধানের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু রাঙ্গামাটি সফরে গিয়ে এক জনসভায় ঘোষনা করেন “পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদেরকে জাতিতে পদোন্নতি করা হলো, আজ থেকে সকলে বাঙালী”। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল বঙ্গবন্ধুর এই ভালবাসা ও মমত্বমাখা বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করার অপপ্রয়াস চালিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করার প্রক্রিয়ায় মেতে উঠেছিলো। এমএন লারমা অবশ্য বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং তার বক্তব্যের প্রকৃত অর্থ বুঝতে পেরেই হয়তো পরবর্তীতে বাকশালে যোগদান করেছিলেন। এ ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশিষ্ট গবেষক ডা. এ কে দেওয়ান তার “পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু” গ্রন্থে লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধু বোঝাতে চেয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশে কোন জাতিভেদ থাকবে না। একজন বাঙালী যে অধিকার ভোগ করে, একজন পাহাড়ীও সেটি ভোগ করার অধিকার রাখবে”

তাহলে কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু হয়েছিল? যে কারণগুলো ইতিমধ্যে আলোচিত হলো সেগুলো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার মতো কোনো বিষয় নয়, তা’ সচেতন মহল নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে সহজে অনুধাবন করতে পারবেন। উপজাতি নেতৃবৃন্দের অনেকেই দাবি করেন, বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে কতিপয়  বিপথগামী, দুষ্কৃতিকারী কর্তৃক হত্যা করা হলে এমএন লারমা এবং তার অধীনস্থদের সশস্ত্র সংগ্রাম করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু বিষয়টি আসলেই কী তাই? শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র কার্যক্রমের প্রস্তুতি ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি হতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে এম এন লারমা তৎকালীন সরকারের কাছে তার দাবি-দাওয়া উত্থাপনের পাশাপাশি সুসম্পর্ক বজায় রাখছিলেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠনের ঘোষণা দিলে এমএন লারমা বাকশালে যোগদান করেছিলেন। সরকারের সাথে সুসম্পর্কের পাশাপাশি সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি অযৌক্তিক। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, যদিও এই বিষয়টি এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোন লেখনীতে উঠে আসেনি, তথাপি খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পানছড়ি এলাকার বয়োবৃদ্ধ লোকজনের সাথে কথা বলে ঐ সময়ের ত্রাশ “সম্ভুগুলো চাকমা”র ডাকাত দলের দৌরাত্ম্য দমনে শান্তি বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায়।

কে এই “সম্ভুগুলো চাকমা”?

সম্ভুগুলো চাকমা মূলত নানিয়ারচ এলাকার বাসিন্দা ছিল। পেশায় ছিল চাঁদের গাড়ির চালক। ১৯৬০-৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মানের সময় সম্ভুগুলো চাকমা তার গাড়িতে করে ভুক্তভোগীদের রাঙ্গামাটির বিভিন্ন স্থান থেকে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন জায়গায় আনা-নেওয়ার কাজ করতো। কিন্তু পরবর্তীতে তার অর্থনৈতিক দৈন্যতা আর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও যুদ্ধাবস্থার সুযোগ নিয়ে সে একটি ডাকাত দল গঠন করে এলাকায় লুটতরাজ শুরু করে। মূলত চাকমা সম্প্রদায়ের সশস্ত্র রাজাকারগণ উক্ত ডাকাত দলে সম্পৃক্ত ছিল।  সম্ভুগুলো চাকমার নেতৃত্বে তার ডাকাত দল ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়গুলোতে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে রাজাকার হিসেবে প্রাপ্ত অস্ত্রের অপব্যবহার করে ব্যাপক লুটতরাজ চালাতো, যা’ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কে অতিষ্ট করে তুলেছিল। এই ডাকাত দলকে শায়েস্তা করার জন্য সন্তু লারমার বড় ভাই শুভেন্দু বিকাশ চাকমা (ভুলু)র নেতৃত্বে স্থানীয় উপজাতি যুবকদের সমন্বয়ে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। এই সংগঠন এলাকার হেডম্যান-কারবারীদের কাছে থাকা পশু শিকারের বেশ কিছু বন্দুক সংগ্রহ করে সম্ভুগুলো চাকমার নেতৃত্বাধীন ডাকাত দলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে।  ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে পানছড়ি উপজেলার লতিবান এর শুকনাছড়ি এলাকায় বিশেষ এই সংগঠনের কর্মীগণ ঐ ডাকাত দলকে পর্যদুস্ত করে এবং সম্ভুগুলো চাকমাকে হত্যা করে। বিশেষ এই সংগঠনটি এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলো বিধায় তখন তারা “শান্তিবাহিনী” নামে পরিচিতি লাভ করে। বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর এম এন লারমা যখন আত্মগোপনে চলে গিয়ে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু করেন, তখন শুভেন্দু বিকাশ চাকমার ঐ দলটিকে ঘিরেই মূলত: শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র কার্যক্রমের সূচনা ঘটে।

ছবি-৩: কাপ্তাই বাঁধ।

শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র কার্যক্রম এ’পর্যন্ত আলোচিত যে কারণেই হোক না কেন তা নবগঠিত সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপজাতিদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত যতগুলো তথাকথিত অবিচার ঘটেছে তার জন্য বাংলাদেশ মোটেই দায়ী নয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মোঘল আমলে চাকমা জনগোষ্ঠীর রাজাগণ “খান” উপাধি গ্রহণে বাধ্য হয়েছিলেন অথবা এই উপাধি তাদের গৌরবান্বিত করত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা অনেকটা নিগৃহীত অবস্থায় ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের ঐতিহ্য “জুম” চাষের ঘোর বিরোধী ছিল ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সরকার, কিন্তু বাংলাদেশ সরকার জুম চাষের পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি অবহিত থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র উপজাতি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান রেখে কখনো জুম চাষের বিরোধিতা করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীর মূল সমস্যা যদি “কাপ্তাই বাঁধ”কে ঘিরে হয়ে থাকে, তাহলে এ বিষয়টি পরিষ্কার যে ওই সময় বাংলাদেশের জন্মই হয়নি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই শান্তিবাহিনী সৃষ্ট সন্ত্রাসের দীর্ঘ ভোগান্তির শিকার হয়েছে।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

আমরা যদি  কল্পনা করে নেই, শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সন্ত্রাস যদি শুরু না হতো, তাহলে হয়তো পার্বত্য চট্টগ্রামে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হতো না, হয়তোবা সমতল এলাকা থেকে এত বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হতো না। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপজাতি বিশেষ করে চাকমা সম্প্রদায়ের সাথে বাঙালি জনগোষ্ঠীর যে ঐতিহাসিক সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তা বজায় রেখেই দেশের উন্নয়নে সকলের অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা যেত। ঐতিহাসিক ভাবে চাকমাদের পাশে বাঙালীরা সবসময় থেকেছে। লাঙ্গল দিয়ে চাষ করা, পরিকল্পিত উপায়ে মাছ ধরা, ফলজ ও বনজ বনায়ন ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে এই দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্ক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের শেষ সময় পর্যন্ত বজায় ছিল। এমনকি পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকেও অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ন ছিল এই সম্পর্ক। চাকমাদের ভাষা আর সংস্কৃতি চট্টগ্রামের আদি সংস্কৃতি আর আঞ্চলিক ভাষার সাথে অনেকটা মিলে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পিসিজেএসএস আর শান্তিবাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত উপজাতি ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত সাধারণ উপজাতিরা বাঙালীদের সাথে মিলে মিশে থেকে শান্তিপূর্ন জীবন-যাপন করতে চায়। এ কারনেই শান্তিবাহিনীর প্রভাব স্বত্বেও ঐ সময় অমিত চাকমা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছে। বর্তমানে মধ্যবয়স্ক শিক্ষিত উপজাতিরা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, হলিক্রস কলেজ, নটরডেম কলেজ কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সময়কার বাঙালী বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে সুসম্পর্কের কথা স্মরণ করেন। পিসিজেএসএস’র বর্তমান সভাপতি সন্তু লারমাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ালেখা করেছিলেন। চাকমা রাজাদের স্ত্রী-কন্যারা বাঙালি পোশাক “শাড়ি” পড়তেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। রানী কালিন্দি রায়ের অধিকাংশ উপদেষ্টারাই ছিল বাঙালি। তাই বাঙালি এবং চাকমা সম্প্রদায়ের আন্তঃসম্পর্ক হয়তো আরো সুদৃঢ় হতো সময়ের পরিক্রমায়। কিন্তু শান্তিবাহিনীর অযাচিত ভাবে অস্ত্র তুলে নেওয়া আর চাকমা সম্প্রদায়ের রাজা ত্রিদিব রায় সহ বেশ কিছু সংখ্যক উপজাতির মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার হিসেবে আবির্ভূত হওয়া, এমন কিছু ঘটনা এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। সময় এবং ইতিহাস সব বিষয়ের উত্তর খুঁজে নেয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিশ্চয়ই চাকমা নেতৃত্বে সৃষ্ট শান্তিবাহিনীর অহেতুক জন্মের যৌক্তিকতা খুঁজে না পেয়ে তাদের পূর্বসূরিদের মনস্তাত্বিক ঘৃনার কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।

 

লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক।

Email: parvedgehaider5235@gmail.com