মানবাধিকারের নামে হস্তক্ষেপ নয়, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রয়োজন দেশীয় সক্ষমতা

মানবাধিকারের নামে হস্তক্ষেপ নয়, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রয়োজন দেশীয় সক্ষমতা

মানবাধিকারের নামে হস্তক্ষেপ নয়, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রয়োজন দেশীয় সক্ষমতা
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মোঃ সাইফুল ইসলাম

বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় (Office of the High Commissioner for Human Rights – OHCHR) স্থাপন নিয়ে সম্প্রতি যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তা নিছক একটি কূটনৈতিক প্রস্তাব নয়—এটি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপর গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও কিছু এনজিও ও তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে, রাষ্ট্রবাদী ও সচেতন নাগরিকদের একাংশ এটিকে বাংলাদেশের ওপর এক ধরনের পরোক্ষ আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপের সূচক হিসেবে দেখছেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর (OHCHR) আদতে একটি নিরপেক্ষ মানবিক সংস্থা নয়—এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি কৌশলগত হাতিয়ার, যেটিকে বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া কিংবা রোহিঙ্গা সংকটে এ দপ্তরের ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বহুবার। বিশেষত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর বিরুদ্ধে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ অভিযোগ তুলে রাজনীতিকরণ একটি বারবার দেখা যাওয়া কৌশল।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। র‍্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, নির্বাচন নিয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ, কথিত গুম-খুন ইস্যুতে একতরফা নিন্দা—এসবই এই ‘মানবাধিকার রাজনীতি’র অংশ। আর এখন সেই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের একটি কার্যালয় স্থাপনের চেষ্টা একে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চলেছে।

এই প্রশ্নও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক যে, জাতিসংঘের কার্যালয় বাংলাদেশে বসানোর আগে কি আমাদের বিচারব্যবস্থা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কিংবা সংবাদমাধ্যম পুরোপুরি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে? যদি কিছু দুর্বলতা থাকে, তা স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের নিজেদের সংস্কার ও উন্নয়নের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। কিন্তু বিদেশি ‘তত্ত্বাবধানে’ মানবাধিকার কার্যক্রম চালানো মানে আমাদের আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় সক্ষমতার প্রতি একটি আস্থাহীন ঘোষণা।

এ দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি অভিযোগ আদালতে যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ পায়। নির্বাচন, সংখ্যালঘু অধিকার, নিরাপত্তা বাহিনীর আচরণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে জনমত ও গণমাধ্যমের সক্রিয়তা যথেষ্ট। তা সত্ত্বেও যদি একটি বিদেশি কার্যালয় বসানো হয়, তবে তা হবে বাংলাদেশের একটি ‘ব্যর্থ মানবাধিকার রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যা দেওয়ার রাজনৈতিক পাঁয়তারা।

জাতিসংঘের এই কার্যালয় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামে। এ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী যেমন ইউপিডিএফ, জেএসএস ও কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর মতো সশস্ত্র গ্রুপগুলো সক্রিয় রয়েছে। তারা প্রকাশ্যে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর গেরিলা হামলা চালাচ্ছে।

OHCHR-এর উপস্থিতি এই গোষ্ঠীগুলোকে ‘জাতিসত্তা’র নামে আন্তর্জাতিক সহানুভূতির সুযোগ এনে দিতে পারে। তথাকথিত ‘আদিবাসী অধিকার’ ও ‘জাতিগত বৈষম্য’ ইস্যু তুলে আন্তর্জাতিক মহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার রাস্তা খুলে যাবে। এমনকি সেনাবাহিনীর অভিযানের বিরুদ্ধেও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বিবৃতি বা নিন্দা আসার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

OHCHR পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণের নামে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। চুক্তির কিছু ধারা এমনিতেই বিতর্কিত ও বাস্তবতা-বিচ্যুত; সেগুলো বাস্তবায়নে জোর খাটানো হলে পাহাড়ে নতুন করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইচ্ছাকৃতভাবে তা প্রচার করছে। জাতিসংঘের অফিস স্থাপন সেই প্রচারণাকে কাঠামোগত রূপ দেবে।

OHCHR-এর মূল কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, তদন্ত ও রিপোর্ট প্রকাশ। ফলে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি—এই সব বাহিনীর প্রতিটি অভিযানকে এখন আন্তর্জাতিক ‘লজিক’ ও ব্যাখ্যার আওতায় ফেলতে হবে। এতে বাহিনীগুলোর স্বাধীনতা ও পেশাদারিত্বে হস্তক্ষেপ ঘটবে এবং মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমে জড়তা সৃষ্টি হবে। এর পরিণতিতে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নড়বড়ে হয়ে পড়ার শঙ্কা আছে।

মানবাধিকার ইস্যুতে জাতিসংঘের রিপোর্ট ও পর্যবেক্ষণ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ব্যবহার হয়। বাংলাদেশে OHCHR স্থাপিত হলে এখানে সংগৃহীত তথ্যকে ভিত্তি করে ভবিষ্যতে উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর শর্ত কঠোর হতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগ, জিএসপি সুবিধা, ভিসা নীতি এমনকি সরাসরি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মতো ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। অতীতে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ রয়েছে।

বিরোধী রাজনৈতিক দল ও কিছু এনজিও ইতিমধ্যে জাতিসংঘ কার্যালয়ের পক্ষে বিবৃতি দিচ্ছে, যেটিকে সরকারবিরোধী কৌশলের অংশ বলেই মনে করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে যেকোনো অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে এই দপ্তরের মন্তব্য বা রিপোর্টকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা জাতীয় ঐক্যে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা তৈরি করবে।

বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপন নিছক মানবিক উদ্যোগ নয়—এটি আন্তর্জাতিক কৌশলের অংশ। মানবাধিকার উন্নয়ন একটি প্রশংসনীয় লক্ষ্য, তবে সেটা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে থেকেই করতে হবে। জাতিসংঘের কার্যালয়ের মাধ্যমে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণের অর্থ—এই দেশের বিচারব্যবস্থা, সরকার ও জনগণের ওপর অনাস্থা ঘোষণা করা।

রাষ্ট্র হিসেবে আমরা ১৯৭১ সালে কারও সাহায্য ছাড়াই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আজও যদি আমাদের ঘাড়ে ‘মানবাধিকার রক্ষার নামে নজরদারির চশমা’ চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদার অবমাননা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এ ধরনের প্রস্তাব অবিলম্বে প্রত্যাখ্যান করা উচিত।

আমরা জাতিসংঘের ‘কার্যালয়’ চাই না, আমরা চাই—মানবাধিকারে বাংলাদেশের নিজস্ব সক্ষমতা ও জাতীয় কর্তৃত্বের শক্তিশালী ভিত্তি।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।