সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ইনানীর অজ্ঞাতবাস

ফিচার ডেস্ক
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আওয়ামীলীগ নেতা ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল। এই মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান গং মামলা। তবে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবেই বেশি পরিচিত, কারণ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল যে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কথিত ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিল। এই অভিযোগে ১৭ জানুয়ারি, ১৯৬৮ সালে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়। ৩৫ জনকে আসামী করে সরকার পক্ষ মামলা দায়ের করে।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের সময় রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন কক্সবাজারে। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের প্রয়াত তৃণমূল আওয়ামীলীগ নেতা আছদ আলী বলির সাম্পান নৌকায় করে মহেশখালীর সোনাদিয়া হয়ে কক্সবাজার আসেন বঙ্গবন্ধু। কয়েকটা দিন কাটানোর জন্য জেলা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার ইনানী অরণ্যে যান। সেখানে ছিলেন প্রভাবশালী উপজাতি নেতা ও বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ফেলোরাম চাকমা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন গিয়েছিলেন ফেলোরাম চাকমার বাড়িতে। সেসময় সেই বাড়িতে বেশ কয়েকদিন অবস্থানও করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ফেলোরাম চাকমা তৎকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুকে আশ্রয় ও খাদ্য জুগিয়ে মহান নেতার আপোষহীন সংগ্রামে জ্বালানী সরবরাহ করেছিলেন। যা ৬০ বছরেরও বেশি পুরনো এক ইতিহাস।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন কক্সবাজার জেলার উখিয়ার ইনানী চেনছড়ি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ৬০ বছরেরও পুরনো সেই ইতিহাসের নাম ‘ইনানীতে বঙ্গবন্ধুর অজ্ঞাতবাস’। সরকারি ঘোষনা অনুযায়ী সাগর পাড়ের চেনছড়ি অরণ্যঘেরা চাকমা পল্লীর প্রয়াত ফেলোরাম রোয়াজা চাকমার বসতভিটা এখন সংরক্ষিত এলাকা। যেখানে সরকারি উদ্যোগে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির স্মৃতিবিজড়িত সেই চাকমা পল্লীতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষে সাইনবোর্ডটি ঝোলানো হয়।
সূত্র মতে, চেনছড়ির অরণ্যঘেরা এই পল্লীর দাপুটে চাকমা নেতা প্রয়াত ফেলোরাম রোয়াজা চাকমা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ভক্ত। বঙ্গবন্ধু এসে উঠেছিলেন সেই ফেলোরাম চাকমার টংঘরে। ইনানীতে বঙ্গবন্ধুর অজ্ঞাতবাসের সময়কালে সখিনা খাতুন নামের এক নারী ভাত রান্না করে দিতেন। সেই বৃদ্ধা সখিনা খাতুন ১১১ বছর বয়সে মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। বঙ্গবন্ধুর ইনানী অরণ্যের অজ্ঞাতবাসের অন্যতম সাক্ষী কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা একেএম মোজাম্মেল হক, উখিয়ার জালিয়াপালং ইনানী-নিদানিয়া এলাকার জমিদার সৈয়দুর রহমান সিকদার, চেনছড়ির চাকমা নেতা ফেলোরাম রোয়াজা চাকমা, তাঁর তিন ছেলে ও দুই নাতিসহ অনেকে মারা গেছেন। তবে কালের সাক্ষী হয়ে এখনো বেঁচে আছেন ইনানী অরণ্যে বঙ্গবন্ধুর খাবার-দাবারসহ দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত সেদিনের তরুণ ছাত্রলীগ নেতা সোনার পাড়ার মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হাকিম মাস্টার ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক উখিয়া রাজা পালং খয়রাতি গ্রামের শতায়ু আবদুল খালেক। ইনানী চেনছড়ি গ্রামের চাকমা নেতা প্রয়াত ফেলোরাম রোয়াজা চাকমার যে বাড়িতে বঙ্গবন্ধু জীবনের কয়েকটি দিন ‘অজ্ঞাতবাসে’ অতিবাহিত করেছিলেন, সেই ভিটায় ঝুলানো সাইনবোর্ডে ‘বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত সংরক্ষিত স্থান’ লেখাসহ সেদিনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসও রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হাকিম, ইনানীর সেই বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর জন্য নিয়মিত বাজার ও মাঝে মধ্যে রান্না করা খাবারও পাঠাতেন। বাড়িটিকে ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত যাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও সিদ্ধান্ত ঐ সিদ্ধান্ত পর্যায়েই রয়ে গেছে, বাস্তবায়ন আর হয়নি। সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলা প্রশাসনের টাঙানো সাইনবোর্ড ছাড়া মূলত সেদিনের বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত সেই বাড়িটি সংরক্ষনের আর কোন উদ্যোগ নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন।
এছাড়া বর্তমানে ভালো নেই ফেলোরাম চাকমা ও তার পার্শ্ববর্তী চাকমা পরিবারগুলো। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইনানীস্থ ইনানী মৌজার উক্ত বাড়ির অবস্থানকে কেন্দ্র করে সরকার শেখ জামাল ইকোপার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে ৩২ কোটি টাকা ব্যায়ে উক্ত প্রকল্প একনেকেও পাশ হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে উখিয়াবাসীর জন্য একটি সুঃখবর হলেও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত ও আতঙ্কিত তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর দূর্দিনের সাথী ফেলোরাম চাকমা ও পার্শ্ববর্তী চাকমা পরিবারের লোকজন। বর্তমানে তারা অনেকটা উচ্ছেদ আতঙ্কে দিনানিপাত করছেন বলেও জানা যায়।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উক্ত জমিতে বসবাসরত চাকমা পরিবারের লোকেরা অনেকটা অশিক্ষিত ও সহজ-সরল হওয়ায় জমিগুলো নিজেদের নামে রেজিষ্ট্রিও করাতে পারেন নি। যার ফলে উক্ত জমিগুলো বর্তমানে সরকারি খাস ভূমি। তবে স্থানীয় সুশীল সমাজ মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি শেখ জামাল ইকোপার্ক গঠনের আগে উক্ত চাকমা পরিবার তথা বঙ্গবন্ধুর দূর্দিনের সাথী ফেলোরাম চাকমার পরিবারকে ভালো একটি জায়গায় পূনর্বাসন করেন তবে সকল চিন্তার অবসান ঘটবে সেখানকার চাকমা অধিবাসীদের।