বঙ্গবন্ধুর পার্বত্য চট্টগ্রাম নীতির পুনর্পাঠ - Southeast Asia Journal

বঙ্গবন্ধুর পার্বত্য চট্টগ্রাম নীতির পুনর্পাঠ

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

এ. বি. চাকমা

বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়িত জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মহানায়ক এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে শাহাদাতবরণ করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রনায়ক। এই সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন, ক্ষুধা, দারিদ্রক্লীষ্ট মানুষের মুখে অন্ন বস্ত্রের সংস্থান, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার ত্রিদেশীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির মীমাংসা এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য যুগোপযোগী নীতি, কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন। এর মধ্যে ভারত থেকে শরণার্থীদের ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করা, দেশের বিপর্যস্ত অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশ সচিবালয় তথা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্বিন্যাস, সংবিধান প্রণয়ন, প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন, চীন ও সৌদি আরব ব্যতীত অধিকাংশ দেশ ও সংস্থার স্বীকৃতি লাভ প্রভৃতি উলে­খযোগ্য। কিন্তু দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে তিনি বা তাঁর সরকারের গৃহীত নীতি সম্বন্ধে কিছু কিছু সাহিত্যে (উৎস অর্থে) এখনো নানামুখী বিতর্ক রয়ে গেছে। আলোচ্য নিবন্ধে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে ১৯টি প্রশাসনিক জেলা ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল ভারত ও বার্মার সীমান্তবর্তী জেলা। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধ ভেঙ্গে পড়ে এবং মধ্য এপ্রিলের মধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাউজান হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকে পড়ে এবং স্থানীয় মুরুব্বিদের তাদের প্রভাবাধীনে এনে রাঙামাটির তথা জেলা সদরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পরের মাসে অর্থাৎ মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ঘাটি রামগড়ও পাকসেনারা দখল করে। এরপর থেকে ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ে পূর্ব পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকসেনাদের অন্যতম শক্ত ঘাটিতে পরিণত হয়। যুদ্ধকালীন সময়টাতে পাকসেনারা মিজো বিদ্রোহীদেরকে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। পাশাপাশি ভয়ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করে স্থানীয়দের সুপ্ত প্রতিরোধ স্পৃহাকে প্রথমে নিস্ক্রিয় এবং যুদ্ধের শেষের দিকে নিজেদের অনুকুলেও চালিত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা বুড়িঘাট, মহালছড়ি, রামগড়, কাপ্তাই, ঘাগড়া, বরকল, পানছড়ি, প্রভৃতি স্থানে গেরিলা আক্রমণ ও সম্মুখ যুদ্ধ চালিয়ে পাকসেনাদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। তার জলন্ত উদাহরণ বাংলাদেশের সাত জন বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ পার্বত্য চট্টগ্রামে মহালছড়ি সন্নিকটে বুড়িঘাটে মরণপণ যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অথবা বাংলাদেশের সর্বত্র সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি সম্বন্ধে কোনো প্রত্যক্ষ সংবাদ সম্পর্কে জানা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না বা পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাকে জানতে দেয়নি। স্বাধীনতার পর স্বদেশে প্রর্ত্যাবত্যানের আগে দিলি­তে ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এবং স্বদেশে ফিরে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠজন ও ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ বিবরণ লাভ করেন। তম্মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস পার্বত্য চট্টগ্রামে কী ঘটেছিল সে সম্বন্ধে তিনি কতটুকু জেনেছিলেন তা সুস্পষ্ট করে এখনো জানা যায়নি। তবে তৎকালীন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায় বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রামের দুটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতের দিনক্ষণ দিয়েছিলেন এবং এরমধ্যে চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মতবিনিময়ও করেছিলেন। কিন্তু ঐ প্রতিনিধি দল বঙ্গবন্ধুর সমুখে যুদ্ধকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি কতটুকু উপস্থাপন করতে পেরেছিল তাও অস্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু নির্ধারিত সময়ে অন্যত্র অতি জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকায় বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মং রাজা মং প্রু সাইনের নেতৃত্বাধীন অন্য প্রতিনিধি দলটি প্রার্থীত সাক্ষাত লাভে অসফল হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি দলটির কাক্সিক্ষত সাক্ষাতটি না হওয়ায় এবং প্রতিনিধি দল কর্তৃক লিখিত আকারে দাবিনামা রেখে আসায় পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে একটি বড় ব্যবধান তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। মুখোমুখি বসে কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে একে অপরের ভাবভঙ্গি অনুধাবন করে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দাবি উপস্থাপন আর কোনো ধরনের আলাপ-পরিচয় ছাড়া হতোদ্যম হয়ে একগুচ্ছ বিশাল দাবি লিখিত আকারে অন্যের হাতে দিয়ে আসার মধ্যে বহু তফাৎ আছে। এভাবে দাবিনামা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় একদিকে যেমন বঙ্গবন্ধুর মতো হিমালয় সদৃশ ব্যক্তিত্ব এবং সম্মোহনী শক্তিসম্পন্ন জননেতা ও বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়কের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয় অন্যদিকে নিজস্ব আইন পরিষদসহ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মতো রাজনৈতিক তাৎপর্যবহ দাবির বিশেষত্বও ম্লান হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। উপস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী সময়ে নানা বিতর্কিত কাহিনীর উৎপাদন করা হয়। সে ধরনের একটি কাহিনী হলো:

১৯৭২ সালে পাহাড়ী জনগণের নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধি দল প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং জাতির জনক শেখ মুজিব(বু)র রহমানের সাথে দেখা করেন। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন সংসদের চাকমা সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, সঙ্গে ছিলেন উপেন্দ্র লাল চাকমাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ১২ জন পাহাড়ী। মানবেন্দ্র লারমার সঙ্গে ছিল শেখ মুজিবের বরাবরে লিখিত একটি স্মারকলিপি। শেখ মুজিব জিজ্ঞাসা করলেন, ওতে কি লেখা আছে। স্মারকলিপিতে দাবি করা হয়েছিল নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন, ১৯০০ সালের বিধিসমূহের সংরক্ষণ, তিন প্রধানের দপ্তরের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, বিধিসমূহের সংশোধনের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ এবং অপাহাড়ীদের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ করা। মুজিব দাবিগুলো সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। উপেন্দ্র লাল চাকমার স্মরণে আছে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘‘ না, আমরা সবাই বাঙালী, আমাদের দুই ধরনের সরকার ব্যবস্থা থাকতে পারে না। তোমরা তোমাদের জাতীয় পরিচয় ভুলে যাও এবং বাঙালি হয়ে যাও।’’ তিনি নাকি হুমকি দিয়ে এও বলেন যে বাঙালী মুসলমানরা পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেয়ে ফেলবে। শেখ মুজিবের অফিসে মিটিং স্থায়ী হয় মাত্র ৩-৪ মিনিট। প্রতিনিধিদেরকে বসতে বলা হয়নি। শেখ মুজিব স্মারকলিপি গ্রহণ করেননি। উপেন্দ্রলাল চাকমার ভাষ্যমতে, তিনি সেটি মানবেন্দ্র লারমার দিকে ছুঁড়ে মেরেছিলেন। [ পা.চ.কমিশন, জীবন আমাদের নয়, ২০০১: ২৪]
কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন খাঁটি জননেতা। তাঁর মহানুভবতা, উদারতা, ও মানবতাবাদী চেতনা তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ করলে বুঝা যায়। তাঁর রাজনীতি সাধারণ মানুষের মুক্তির রাজনীতি। ধর্ম, জাতপাত প্রভেদ করা তিনি বিশ্বাস করতেন না। ১৯৭২ সাল থেকে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক। সুতরাং পার্বত্য প্রতিনিধিদেরকে তিনি অফিসে বসতে বলবেন না একথা বিশ্বাস করা কঠিন। তিনি স্মারকলিপি গ্রহণ না করতে পারেন কিন্তু সেটি মানবেন্দ্র লারমার দিকে ছুঁড়ে মারার মতো অসৌজন্যমূলক ও শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করেছিলেন এটা অকল্পনীয়।

১৯৭৩ সালে রাঙামাটিতে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ভাষণ নিয়েও অনেক নেতিবাচক ধ্যান ধারণা প্রচলিত আছে। জনশ্র“তি আছে ঐ ভাষণে তিনি পাহাড়িদেরকে বৃহত্তর বাঙালি জাতির অন্তর্ভুক্ত করে উপজাতি থেকে বাঙালি জাতিত্বে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর এতেই ঘটে যায় বিপত্তি। শুরু হয় নানান রটনা। বঙ্গবন্ধু পাহাড়িদেরকে বাঙালি বা মুসলমানে পরিণত করার কথা ঘোষণা করেছেন। উপজাতীয় পরিচয় মুছে ফেলবেন প্রভৃতি (জে.বি. চাকমা, ১৯৯৩:৫২)।

সারাজীবন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় অটল বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু যিনি ১৯৫৫ সালে তাঁর প্রাণপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নামের ওপর সাহসী অস্ত্রোপচার চালিয়ে ‘মুসলিম’ শব্দটি মুছে দিয়েছিলেন তাঁর সম্পর্কে মুসলমান বানানোর গল্প রটানো বেমানান। বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজা ত্রিদিব রায়কে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বাসায় ডেকে আওয়ামী লীগে যোগদানের কথা বলেছিলেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনের অনুরোধ করেছিলেন। ত্রিদিব রায়কে না পেয়ে চারু বিকাশ চাকমাকে জাতীয় পরিষদে প্রার্থী করেছিলেন। একইভাবে প্রাদেশিক পরিষদে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন রাজার চাচা কুমার কোকনদাক্ষ রায়কে। অধিকন্তু ইনিই বঙ্গবন্ধু যিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে রাজা ত্রিদিব রায়কে আমেরিকা থেকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ত্রিদিব রায়ের মা ও কাকাকে নিউইয়র্কে পাঠিয়েছিলেন। ইনি সেই বঙ্গবন্ধু যিনি সারাজীবন নিপীড়িতের পক্ষে সংগ্রামমুখর ছিলেন। অথচ অপবাধ দেওয়া হলো তিনি উপজাতি পরিচয় মুছে ফেলার জন্য বাঙালিত্বে প্রমোশন দিয়েছেন।

এছাড়া বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে পরবর্তী সময়ে যেসকল পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা পর্যালোচনা করলে তাঁর পার্বত্য চট্টগ্রাম নীতি সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া সম্ভব। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে একজন সম্ভ্রান্ত পাহাড়ি ব্যক্তির সহধর্মিনীকে মনোনীত ও নির্বাচিত করেছিলেন। যদিও তাঁর নিকট বিকল্প প্রার্থীর অভাব ছিল না কারণ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ১টি মহিলা আসন সংরক্ষিত ছিল। বঙ্গবন্ধু অস্তিত্ব সংকটে পতিত চাকমা রাজ পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন ত্রিদিব রায়ের নাবালক ছেলে দেবাশীষ রায়কে নতুন চাকমা রাজা ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধুর অন্তরে চিরজাগরুক এই প্রগাঢ় মহানুভবতাকে উপলব্ধি করতে না পারা মানসিক দৈন্যতার পরিচায়ক। সত্তরের দশকে চাকমা রাজপরিবার সীমাহীন নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা ও অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছিল। মহিলা সাংসদ সুদীপ্তা দেওয়ানের মধ্যস্থতায় বঙ্গবন্ধু ত্রিদিব রায়ের অনুজ কুমার সমিত রায়কে সরাসরি রাঙামাটি সরকারি কলেজে ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এতে তৎকালীন রাজমাতা বিনীতা রায় ও পুরো রাজপরিবার আশান্বিত হয়। ফিরে আসে স্বস্তি।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি রাঙামাটিতে প্রদত্ত এক ভাষণে উপজাতিদের ‘জাতীয় সংখ্যালঘু’ হিসেবে ঘোষণা করে তাদের ভূমি অধিকার, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সুরক্ষার ঘোষণা দেন। জাতীয় রক্ষীবাহিনী, পুলিশ বাহিনী বাহিনীতে ২০০ ও ৩০০ জন পাহাড়িকে নিয়োগের কথা ঘোষণা করেন। এবং তাঁর জীবদ্দশায় ঘোষণা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক অনগ্রসরতা সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। সেজন্য তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য একটি বিশেষ উন্নয়ন বোর্ড গঠনের ঘোষণা ১৯৭৩ সালেই দিয়েছিলেন। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী পাহাড়ি ছাত্রদেরকে তিনি বৈদেশিক বৃত্তি লাভের সুযোগ করে দেন। এতে রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ভারত, বুলগেরিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রায় ২৫ জন পাহাড়ি ছাত্র উন্নতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ পান। অধিকন্তু পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা যাতে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় হোস্টেলে থেকে স্বল্প খরচে পড়াশুনা চালিতে যেতে পারে তার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকারিভাবে দুটি বাড়ি বরাদ্দ দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি উপজাতীয় শিক্ষার্থীদের জন্য মেডিকেল, প্রকৌশল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটসমূহে প্রয়োজনীয় আসন সংরক্ষণে নীতিগত অনুমোদন এবং নির্দেশ প্রদান করেন।

পাহাড়িদের ধর্ম সম্বন্ধেও বঙ্গবন্ধুর নীতি ছিল নিরপেক্ষ, উদার ও রাষ্ট্রনায়োচিত। তিনি ১৯৭৪ সালে শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভান্তের লংগদু তিনটিলাস্থ বনবিহার উন্নয়নের জন্য ৫০০০ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের হস্ত ও কুটির শিল্পের উন্নয়নে তিনি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে তাতে পাহাড়িদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। এতে পাহাড়িদের নিজস্ব বুনন শিল্প সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রসারিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক উন্নয়নেও তাঁর পদক্ষেপ ছিল অন্তর্ভক্তিমূলক। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল পাস করে দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। সে-ব্যবস্থাধীনে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। সংশোধনী মোতাবেক দলগঠনের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। ১৯৭৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি নতুন জাতীয় রাজনৈতিক দলের নাম ঘোষণা করেনÑ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ সংক্ষেপে বাকশাল। বাকশাল শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নাম ছিল না, ছিল একটি নতুন রাষ্ট্রদর্শন ও শাসনব্যবস্থা। তিনি বাকশাল কাঠামোর অধীনে যে ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির নাম ঘোষণা করেন তাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মং রাজা মং প্র“ সাইনকে একমাত্র পাহাড়ি সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশে ১১৫ জন বিশিষ্ট একটিমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া বিশাল সম্মান ও গৌরবের ব্যাপার। অতপর তিনি ১৯৭৫ সালের জুনে সারা দেশে ৬০টি জেলা-গভর্নর পদ সৃষ্টি করেন। এই গভর্নর পদ ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন ও নির্বাহী প্রধানের পদ। বঙ্গবন্ধুর দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘প্রত্যেক জেলায় অর্থাৎ বর্তমান মহকুমাসমূহে একটি করে এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল থাকবে এবং তার একজন গভর্নর থাকবেন। তিনি স্থানীয়ভাবে শাসন ব্যবস্থা চালাবেন। … জেলা গভর্নরের কাছে যাবে আমার ওয়ার্কস প্রোগ্রামের টাকা। তাঁর কাছে যাবে আমার খাদ্য সামগ্রী। তাঁর কাছে যাবে আমার টেস্ট রিলিফ, লোন, বিল ও সেচ প্রকল্পের টাকা। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ডাইরেক্ট কন্ট্রোলে এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল ও ডিস্ট্রিক্ট এ্যাডমিনিস্ট্রেশন পরিচালিত হবে।’’

অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু কেন্দ্রীয় প্রশাসনের প্রধান, দলের চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরাসরি গভর্নর নিয়োগ করেন। গভর্নর হতেন প্রেসিডেন্টের খাস প্রতিনিধি। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে তিনটি জেলা গঠিত হয়। ঐ তিন জেলার মধ্যে তিনি বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে দুই উপজাতীয় রাজা যথাক্রমে মং শৈ প্রু চৌধুরী ও মং প্রু সাইনকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। রাজা দেবাশীষ নাবালক হওয়ায় তিনি রাঙামাটি জেলার তৎকালীন ডিসি আবদুল কাদেরকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন; যিনি ছিলেন একজন উপজাতিবান্ধব আমলা। সাবেক কূটনীতিক ফারুক চৌধুরীর ধারণা: ‘‘বঙ্গবন্ধুর তখনো আশা হয়তোবা রাজা ত্রিদিব রায় একদিন দেশে ফিরে গ্রহণ করবেন গভর্নরের দায়িত্বভার।’’ গভর্নরভিত্তিক শাসনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ অর্থাৎ সম্পাদক হিসেবেও তিনি তিনজন পাহাড়িকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। সবচেয়ে আশাপ্রদ ঘটনা ছিল এই বাকশাল ব্যবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রধান মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও তাঁর সহচর চাথোয়াই রোয়াজাও যোগ দিয়েছিলেন। গভর্নরি কাউন্সিল ভিত্তিক জেলা প্রশাসন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পঁচাত্তরের জুলাই মাসে ঢাকায় গভর্নরদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে বহু শতাব্দী পর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়ি নেতৃত্বকে রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থার মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব পাহাড়িদের হাতে চলে আসার ক্ষেত্র তৈরি হয়। কেন্দ্র ও অঞ্চলের মধ্যকার রাজনৈতিক ও মনস্তাত্তি¡ক দুরত্ব ঘুচে গিয়ে সম্প্রীতি, সৌহার্দ ও আস্থার মেলবন্ধন তৈরি হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে সঞ্চারিত হয় নতুন আশা। কিন্তু ১৫ই আগস্টের ভোরে ঘাতকরা জঘন্যতম পৈশাচিকতায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করলে সকল আশার প্রদীপ নিভে যায়। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে নেমে আসে অন্ধকার। পার্বত্য চট্টগ্রামেও শুরু হয় অন্ধকার যুগ।

বঙ্গবন্ধুর পার্বত্য চট্টগ্রাম নীতি শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপট দিয়ে বিবেচনা না করে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়, মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস তাঁর কারাবন্দী জীবন এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের মধ্যে নানা উপদলীয় স্বার্থগোষ্ঠীর উত্থান, স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধস্ত ক্ষুধা দারিদ্রপীড়িত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে তাঁর ঐকান্তিক ও অন্তহীন প্রচেষ্টার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। সমস্যাসংকুল পরিস্থিতিতে দেশ পরিচালনার প্রারম্ভে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের প্রত্যাশানুযায়ী সাড়া দিতে না পারলেও তিনি ধীরে ধীরে পার্বত্য জনগণের অন্তরের মর্মব্যাথা ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন। সেজন্য তিনি বাকশাল কাঠামোর অধীনে তিন পার্বত্য জেলা তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনভার পাহাড়িদের হাতে তুলে দেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে উঠত পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুখী সমৃদ্ধ ‘জাতিগত সংখ্যালঘু’ অধ্যুষিত অঞ্চল।

লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।