পাহাড়ে প্রকৃত শান্তির খোঁজে - Southeast Asia Journal

পাহাড়ে প্রকৃত শান্তির খোঁজে

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মোঃ সাইফুল ইসলাম

পার্বত্য শা‌ন্তিচুক্তির পর কেটে গেছে ২৪টি বছর। দুই যুগ আগের এই চুক্তির ফলে সরকারের সঙ্গে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর সশস্ত্র সংঘাতটা এড়ানো গেছে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর যুদ্ধে নামা মানুষগুলো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছে-মোটা দাগে সাফল্য এটাই। তবে পাহাড়ি সংগঠনগুলো এখনও দাবি করে পূর্ণাঙ্গ চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি সরকার। তারা পৃথক পৃথক প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে শোনায় হতাশা, ক্ষোভ ও অভিমানের গল্প। অন্যদিকে, সশস্ত্র যুদ্ধ এড়াতে পারাকেই সবচেয়ে বড় স্বস্তি ধরে নিয়ে সরকার ও সরকারি দলের পক্ষ থেকে এই দিনটিকে ঘিরে চলে শান্তিচুক্তির সাফল্য প্রচারে নানামুখী তৎপরতা।  তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী স্থানীয়দের সারাবছরের যে বিশ্লেষণ তাতে পাহাড়ি-বাঙালিদের অভিন্ন মন্তব্য, পাহাড়ে প্রতিবছরই বাড়ছে চাঁদাবাজি; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দলগুলো চার খণ্ডে বিভক্ত হওয়ায় মোটেও কমেনি সংঘাত। সেই যুদ্ধটা এড়ানোর স্বস্তি আছে তবে প্রকৃত শান্তি এখনও ফেরেনি পাহাড়ে।

সরাসরি সংঘাত বন্ধে ১৯৯৭ সালে সরকারের পক্ষে তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমা এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। সন্তু লারমার দল এরপর গত দুই দশক ধরেই দাবি করে আসছে চুক্তির অনেকগুলো ধারা বাস্তবায়ন করেনি সরকার। তবে তাদের বিরুদ্ধে পাহাড়ি অন্য সংগঠনগুলোরই অভিযোগ, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পুরোপুরি অস্ত্র সমর্পণের কথা থাকলেও এখনও তার দলের বিরুদ্ধে অস্ত্রবাজি এবং প্রতিপক্ষকে হত্যার অভিযোগ ওঠে। অস্ত্রের পথ ছেড়ে প্রথাগত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে জেএসএস আসতে না পারার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল প্রতিপক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। কারণ, চুক্তির সময়েই পাহাড়ে বিবদমান প্রতিপক্ষ ছিল ইউপিডিএফ। এছাড়াও জেএসএস এর প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র লারমার অনুসারীরা মূল আদর্শে থাকতে চাওয়ায় দলটি বিভক্ত হওয়ায় পাহাড়ি প্রতিপক্ষের সংখ্যা বেড়ে যায়। পরবর্তীতে আদর্শ কিংবা স্বার্থের সংঘাতে ইউপিডিএফও ভেঙে যাওয়ায় জুম্ম জাতির অধিকারের কথা এখন কেবলই আদর্শিক স্লোগান; নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদেরই অভিযোগ রয়েছে, ঐক্য নয় পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র তাক করে এমন আদর্শের কথা বলে সংগঠনগুলো।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় গত ২৪ বছরে খুন হয়েছে ৪৬৭ জন। এর মধ্যে ৩২৭ জন পাহাড়ি এবং ১৪০ জন বাঙালি। আহত হয়েছে মোট ১ হাজার ২১৬, যার মধ্যে বাঙালি ৮২৪ এবং পাহাড়ি ৪৭২। অথচ শান্তিচুক্তি হওয়ার পর এই হত্যাযজ্ঞ থেমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো সেই অস্ত্রের দামামা। চাঁদাবাজি ও অপহরণ বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে জেএসএস-ইউপিডিএফের মধ্যে কয়েক বছর ধরে চলছে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। প্রশাসনের অদৃশ্য ভূমিকা পালনের কারণে দিন দিন আরো বেড়ে উঠেছে পাহাড়ে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই।

চাঁদাবাজি ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বলি হয়ে এভাবেই পাহাড়ের রাস্তায় মাঝে-মধ্যেই পড়ে থাকে লাশ। স্বজনদের এমন আর্তনাদ যেন শান্তিচুক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পাহাড়ে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার জন্য তাহলে দায়ী কারা? 

ইতোমধ্যে পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৪ বছর পূর্তি হয়েছে। চুক্তির ৭২টি ধারার ৪৮টিই পূর্ণাঙ্গ এবং ১৫টির আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষার হার বৃদ্ধিসহ পাহাড়িদের জীবনযাত্রার মানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু শান্তিবাহিনীর আদলে সশস্ত্র গ্রুপগুলো সক্রিয় রয়েছে। প্রতিনিয়ত খুন, ধর্ষণ, অপহরণ ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধ করে চলেছে এসব গ্রুপ।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক-দশমাংশ ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত তিন জেলার মোট আয়তন ৫ হাজার ৫০০ বর্গমাইল। জনসংখ্যা মাত্র ১৬ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ বাঙালি আর বাকি ৮ লাখ ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। শান্তিচুক্তির আগে ২৪ বছরে শান্তিবাহিনীর হাতে নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৪৩ জন মারা যান। ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সরকারি দলের ৫ নেতাকে হত্যা করেছে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। কিছুদিন পরপরই অশান্ত হয়ে উঠছে পার্বত্যাঞ্চল। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায় পাহাড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ঘটছে প্রাণহানি। পার্বত্যাঞ্চলে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের নামে সক্রিয় আঞ্চলিক সংগঠনগুলো নিজেরাই পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকছে সবসময়। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিনিয়ত চলছে বন্দুকযুদ্ধ ও অপহরণের ঘটনা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মারমা নৃগোষ্ঠীর একাধিক বাসিন্দা গত দুই যুগের রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, পাহাড়ে আগে যুদ্ধ ছিল। ফলে তখনও শান্তি ছিল না। যুদ্ধ থামার পর পাহাড়ি সংগঠনগুলোর বিবাদ তো লেগেই আছে। তবে নিজেদের শান্তি এখনও আসেনি-এমন হতাশা জানিয়ে এই প্রবীণ মারমা সদস্যরা বলেন, ‘আগের তুলনায় পাহাড়ে ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে চাঁদাবাজি। এই চুক্তির আগে তাদের চাঁদা দিতে হতো যুদ্ধের নামে, এরপর তারা মুক্তি পাবেন আশা করলেও সেই সময়টি কখনোই আসেনি। আগে মোটামুটি হারে একটা চাাঁদ নিয়ে যেত সশস্ত্র সংগঠনগুলো। তবে গত ২৪ বছরে এই সংগঠন চার টুকরা হওয়ায় সবাই তাদের কাছে আসে চাঁদা নিতে। গরু-ছাগল, মুরগি, ধান, কলা, জুমের ফসল কিছুই বাদ যায় না চাঁদার আওতা থেকে। ছেলেরা চাকরি করলেও চাঁদা দিতে হয়, ব্যবসা করলেও দিতে হয়। কেউ রশিদ দিয়ে চাঁদা নেয়, কেউ রশিদ ছাড়াই চোখ পাকিয়ে না হয় অস্ত্র দেখিয়ে। ভয়ে আমরা কিছুই বলতে পারি না। আগে শুধু আমাদের মানে পাহাড়িদের চাঁদা দিতে হতো। এখন হাট-বাজারসহ বাঙালিদেরও মাঠের ফসল, বাড়ির এটা-সেটার জন্য চাঁদা দিতে হয়। প্রায়ই চাঁদা আদায়কারীদের দ্বারা অপহরণ, মারধর, হত্যার শিকার হন অনেকেই। সব কথা কাগজে উঠে আসেও না। অনেকেই ভয়ে কারও কাছে কোনও অভিযোগ করে না। ’

সন্ত্রাসীদের হামলার সময়ে ব্যবহৃত গুলি ও কার্তুজ বক্স।

নাম প্রকাশ না করে এই এলাকার বেশ কিছু বাঙালি বলেছেন, পাহাড়ি গ্রামগুলোতে নিরাপত্তার বড়ই অভাব। নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য পুলিশ কিংবা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের রাতে সচরাচর পাওয়া যায় না। পাহাড়ি সংগঠনগুলো এখনও সশস্ত্র। বিশেষ করে রাতে তারা অস্ত্র ছাড়া এক পাও ফেলে না। যুদ্ধ থামলেও এখনও প্রতিপক্ষের অ্যামবুশের স্বীকার হওয়ার ভয় আছে সব পক্ষের। প্রতিদিনই কেউ না কেউ প্রতিপক্ষের টার্গেট হয়। রাতে তার খোঁজে চলে অভিযান। এ কারণে রা‌তে পাহাড়ি গ্রামগু‌লো প্রায়ই  পুরুষশূ‌ন্য থা‌কে। মা‌সের পর মাস, বছ‌রের পর বছর ধরে অনেক নেতা নিজ বা‌ড়িমুখো হন না। গত তিন বছর শুধু বান্দরবানেই সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়ে‌ছে ২৫ জন। এছাড়াও তিন পার্বত্য জেলায় একশ’র বেশি মানুষ নিহত হয়ে‌ছে।

এমন পরিস্থিতিতে পাহাড়ে বাস করা বাঙালিদের বেশিরভাগ সময়ে প্রতিবাদের বদলে সমঝোতা করেই থাকতে হয়। চাঁদা দিতে হয় সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নির্দেশ মাফিক। তবে এই চাঁদাবাজি স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের ওপরে আরও বেশি হয় বলে জানান তারা। পুরো দেশের সঙ্গে এখানেই ব্যতিক্রম তিন পার্বত্য জেলা; আইন শৃঙ্খলা এখানে মাঠ পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ ও শক্তি প্রয়োগ না করে শান্তি ফিরিয়ে আনা সহজ নয়।

বান্দরবান জেলা যুগ্ম দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী অ্যাডভো‌কেট মিজানুর রহমান ব‌লেন, একের পর এক মানুষ খুন-গুম, চাঁদাবাজি, অপহরণের শিকার হলেও সন্ত্রাসীরা বরাবরই রয়ে‌ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতে পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যাচ্ছে। তি‌নি ব‌লেন, সম্প্র‌তি তা‌দের বিরু‌দ্ধে মামলাও বৃ‌দ্ধি পা‌চ্ছে। কিন্তু বে‌শিরভাগ ক্ষে‌ত্রেই আসামিরা র‌য়ে‌ছে ধরাছোঁয়ার বাই‌রে।

বিরোধী দলীয় এক রাজনৈতিক নেতা বলেন, ১৯৯৭ সালে তড়িঘড়ি করে শা‌ন্তিচুক্তিটি সম্পাদনসহ চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলে গহীন অরণ্য থে‌কে সেনা ক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার করে পুরো পার্বত্য এলাকাকে অনিরাপদ করে তুলেছে সরকার। আর এতে খুন-গুম, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা আরও বেড়ে গেছে। তার দাবি, এ চু‌ক্তি বা‌তিল ক‌রে পাহাড়ি- বাঙালি উভয় প‌ক্ষের প্র‌তি‌নি‌ধি রে‌খে নতুন ক‌রে চু‌ক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। নতুবা একতরফা ভা‌বে চু‌ক্তি বাস্তবায়ন কর‌লে পাহা‌ড়ে কখ‌নোই প্রকৃত শা‌ন্তি ফি‌রে আস‌বেনা।

ক্ষমতাসীন দলের জেলা পর্যায়ের এক নেতা বলেন,, ১৯৯৭ সালে কোনও তৃতীয় পক্ষ বা দে‌শের সহযোগিতা ছাড়াই আওয়ামী লীগ এই চুক্তি সম্পাদন করেছিল। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামীলীগ সরকার প্রথম থে‌কেই খুবই আন্তরিক। চুক্তি বাস্তবায়নে উভয়পক্ষের এগিয়ে আসার দরকার। কিন্তু এতে জেএসএস এর কোনও ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।

ঘটনার পর পুলিশে এভাবেই দলবলসহ অভিযানে নামে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি  (জেএসএস) এর কেন্দ্রীয় ক‌মি‌টির সহ-সভাপ‌তি কেএসমং মারমা ব‌লেন, জেএসএস’র দাবিকৃত চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনেও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং সরকার নানাভাবে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে‌ছে। এতে পাহা‌ড়ের মানু‌ষের অধিকার ক্ষুণ্ন হ‌চ্ছে। চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে সরকারকে তাগিদ দেন তিনি।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ঐকমত্যের সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির আওতায় সে সময়কার বিচ্ছিন্নতাবাদী শান্তি বাহিনীর ২ হাজার সশস্ত্র কর্মী অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। অবসান ঘটে অব্যাহত রক্তপাতের। দুঃখজনক ব্যাপার, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এখনো এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের দিকে সবসময় বন্দুক তাক করে থাকছে। প্রায়ই শোনা যাচ্ছে পাহাড়ি জনপদে অপহরণ, রক্তাক্ত সংঘর্ষ, জমি দখলের খবর। পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আঞ্চলিক গ্রুপগুলোর সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে হবে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করে এর সুফল দৃশ্যমান করতে হবে পার্বত্যবাসীর কাছে।