কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো: সন্তু লারমা - Southeast Asia Journal

কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো: সন্তু লারমা

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

রাজনৈতিক দিকদর্শন নিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লড়াইকে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’ এর সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেছেন, আজকে বাংলাদেশের যে বাস্তবতা, সেই বাস্তবতায় সমাজের মধ্যে নিগৃহীত, নিপীড়িত, সব ক্ষেত্রে বঞ্চনা-লাঞ্ছনার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছেন।

কিছু ক্ষণ আগে সংগ্রামী নেতা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে প্রিয়জন বলে গেছেন। পানির কারণে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে। কোথায় যাবো আমরা, কাছে যাবো? সে জন্য রাজনৈতিক দিকদর্শন খুঁজে পেতে হবে।

শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম জন্মলগ্ন থেকেই সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের আদর্শগত দিককে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা সংখ্যায় কম হতে পারি। এখানে ঘুরে ফিরে যারা আসছেন, যাদের মধ্যে দিকদর্শন আছে, মৌলিক মানবাধিকারের আদায়ের লড়াইয়ে তারা নিবেদিত। ’

সদ্য প্রয়াত প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, জাতীয় সম্মেলনে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভূমি নিয়ে, সামাজিক ও সংস্কৃতিকভাবে দমন-পীড়ন— সব বিষয়ে বক্তব্য উঠে এসেছে।’

রাজধানীর আগারগাঁও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে এই সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সংগঠনটির ভূমি ও আইন বিষয়ক সম্পাদক উজ্জ্বল আজিম ও কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথিন প্রমিলা।

আলোচনা সভায় সংহতি বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বিশিষ্ট নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মেসবাহ কামাল, বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ প্রমুখ।

আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের নারী বিষয়ক সম্পাদক ফ্লোরা বাবলী তালাং, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক চাইখথোয়াই মারমা।

শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা নিজেদের মাতৃভাষা, স্ব স্ব শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। অনেক কঠিন সংকটের মুখেও আমরা টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। তাদেরকে পিছিয়ে রেখে বাংলাদেশ সর্বাঙ্গ সুন্দর হতে পারে না।’

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘এটা আমাদের জাতীয় জীবনে লজ্জার যে জাতি রাষ্ট্র গঠনের সময়ে আমরা একটা সুন্দর সংবিধান রচনা করতে পারলেও আমরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে পারিনি। বরং তাদেরকে আমরা বাঙালি হয়ে যেতে বললাম, আমরা তাদের রক্ষা করতে পারছি না। কিন্তু আমরা জানি যে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরাও এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল।’

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও সন্তু লারমার নেতৃত্বে এই চুক্তির অনেক অংশ বাস্তবায়ন হলেও অনেক কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। চুক্তি হয়েছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা জনগণের। কাজেই যে সরকারই আসুক তা বাস্তবায়ন করা দরকার। তাছাড়া সংখ্যালঘু জাতি সত্ত্বাগুলো রক্ষায় সুরক্ষা আইন দরকার এবং একটা কমিশন গঠন করা দরকার।’

নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশে কোনও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নেই— যা আছে সব লুণ্ঠনের রাজনীতি। সেটা হলো— সংখ্যালঘুর বাড়ি আক্রমণ করা এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পল্লি আক্রমণ করা। আর আক্রমণের পর তাড়িয়ে দিয়ে তাদের যা আছে তা লুট করা।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা নানাভাবে ব্যবহার হচ্ছে। তাদের সমস্যার সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কী, তা পরিষ্কার করতে হবে। এটা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকেও বুঝে নিতে হবে। উন্নয়নের নামে দুর্বৃত্তায়নের যে ধারা অব্যাহত আছে, এটার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, ‘দেশে বাংলা ছাড়াও আরও ৪৩টি ভাষা আছে। এই ভাষাগুলোর মধ্যে যে বহুত্ব, সে বহুত্বের স্বীকৃতি চেয়েছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং সংগ্রাম করছেন সন্তু লারমা। এই বহুত্বের স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক হতে পারে না।’

বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘চলমান অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা যুবকেরা বেশ মাজা শক্ত করে দাঁড়িয়েছে। মধুপুর অঞ্চলে লেক খনন প্রকল্পের বিরুদ্ধে যুবকেরা রুখে দাঁড়িয়েছে। বান্দরবানেও ফাইভ স্টার হোটেল প্রকল্পের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল সেখানকার আদিবাসী যুবকরা। এভাবে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা দেখছি, বান্দরবানের লামা রাবার কোম্পানি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভূমি দখল করছে। সরকার এত শক্তিশালী যে আমাদের সবসময় তটস্থ থাকতে হয়। কিন্তু একটা রাবার কোম্পানিকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সরকার আসলে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে না।’

আলোচনা সভার আগে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্য ‘মাদল’ বাজিয়ে জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করা হয়।