খাগড়াছড়িতে একের পর এক অপহরণ: প্রশাসনের নীরবতায় উদ্বেগ বাড়ছে
![]()
মোঃ সাইফুল ইসলাম
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাজুড়ে একের পর এক অপহরণের ঘটনায় চরম উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে। ফার্নিচার ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, মোবাইল টাওয়ারের টেকনিশিয়ান—কাউকেই রেহাই দিচ্ছে না সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা। প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় এসব ঘটনা এক ভয়াবহ নিয়মিত চিত্রে রূপ নিচ্ছে।
২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর সকালে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার আপার পেরাছড়া এলাকায় নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অপহরণ হন বাঙালি ব্যবসায়ী মোঃ সফিকুল ইসলাম রাসেল (৩৩)। ঘটনার সময় তিনি শান্তি রঞ্জন চাকমার মালিকানাধীন টিনের ঘরে নিজের কাঠের দোকানে কাজ করছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তরা তাকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে দীর্ঘ ১৭ মাস কেটে গেলেও তার কোনো খোঁজ মেলেনি। জীবিত না মৃত—এমনটুকু খবরও পায়নি পরিবার।
রাসেলের ভাই মোঃ জহিরুল ইসলাম প্রথমে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন (জিডি নম্বর: ৯৯২, তারিখ: ০৯/১১/২০২৩)। পরে তিনি খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণ ও অর্থ আদায়ের অভিযোগ এনে দণ্ডবিধির ৩৬৪/৩৮৫/৩৮৬/৩৪ ধারায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় নাম উল্লেখসহ অভিযুক্ত করা হয়: ১. প্রদীপ চাকনা মরুজ্যোতি (৪৩), পিতা: ভারত চন্দ্র চাকমা, গ্রাম: খইয়াতলী (রিজার্ভ ফরেস্ট), থানা: বাঘাইছড়ি, জেলা: রাঙ্গামাটি। ২. মিঞ ধন চাকদা ও সুজন (২৭), পিতা: মৃত রজনী কুমার চাকমা, গ্রাম: শান্তিনগর, গুলশাখালী, থানা: লংগদু, জেলা: রাঙ্গামাটি। ৩. সন্ধ্যা ঢাকমা (মৌসুমী, ২৪), স্বামী: মিক্রধন চাকমা, গ্রাম: শান্তিনগর, গুলশাখালী, লংগদু, রাঙ্গামাটি। ৪. বরুন চাকমা (২৩), পিতা: ধনঞ্জয় চাকমা, গ্রাম: উত্তর তারাবুনিয়া, থানা: দীঘিনালা, জেলা: খাগড়াছড়ি। ৫. ধনঞ্জয় চাকমা (৫৫), পিতা: মৃত কলো চাকমা, গ্রাম: তারাবানিয়া, থানা: দীঘিনালা, জেলা: খাগড়াছড়ি।
এছাড়াও মামলায় অজ্ঞাত আরও ৪-৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। ঘটনার পর একজনকে আটক করা হলেও দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও কোনো আসামিকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। মামলার অগ্রগতি নেই বললেই চলে।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই প্রশাসনের দ্বৈত আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। গত ১৬ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ শিক্ষার্থী খাগড়াছড়ি থেকে ফেরার পথে অপহরণ হলে, প্রশাসন ও নিরাপত্তাবাহিনী তড়িৎ অভিযানে নামে, কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনায় প্রশাসনের তৎপরতা যেমন প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি একই এলাকায় অপহৃত রাসেলকে ১৭ মাসেও উদ্ধার না করতে পারার ঘটনায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে জনমনে ঘোরতর ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা রাকিব হোসেন বলেন, “৫ উপজাতি শিক্ষার্থী উদ্ধারে প্রশাসন ও প্রশাসন যেমন সক্রিয় ছিল, রাসেলের ক্ষেত্রে তেমনটা কেন নয়? রাসেল কি এই রাষ্ট্রের নাগরিক নয়?” তিনি আরও বলেন, “আমরা শুধু জানতে চাই—রাসেল বেঁচে আছে না মারা গেছে। তার পরিবারকে অন্তত এই তথ্যটা দেওয়া হোক।” এই বক্তব্য তিনি নিজের ফেসবুক আইডি ‘Justice Rakib’ থেকে প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানান।
এদিকে সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে ১৯ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে। মানিকছড়ি উপজেলার ময়ুরখীল এলাকায় রবি মোবাইল টাওয়ারে মেরামতের কাজে গিয়ে অপহৃত হন দুই টেকনিশিয়ান—মো. ইসমাইল হোসেন (৩৫) ও আব্রে মারমা (২৫)। স্থানীয়দের অভিযোগ, টাওয়ারের কাজ শেষে নামার পর মোটরসাইকেলে করে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা তাদের অপহরণ করে নিয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব অপহরণের পেছনে সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ চক্রের জড়িত থাকার প্রমাণ আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ ও তাদের ছত্রছায়ায় থাকা দুর্বৃত্তরা নিয়মিত চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দিলে টাওয়ার ধ্বংস, জেনারেটর পুড়িয়ে দেওয়া, এমনকি টেকনিশিয়ান অপহরণের ঘটনাও ঘটে।
একাধিক অপহরণ, প্রশাসনের নির্লিপ্ততা এবং বিচারের অগ্রগতির অভাব এলাকাবাসীর মনে চরম নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসনের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকলে খাগড়াছড়ি অপহরণের অভয়ারণ্যে পরিণত হবে।
সুশাসনের দাবিতে জনসাধারণ দ্রুত প্রশাসনের জোরালো পদক্ষেপ ও সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।