পাহাড়ের সন্ত্রাসী দলগুলোর দাপট: সরকারের কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া পাহাড়ে শান্তি সম্ভব নয়

মোঃ সাইফুল ইসলাম
পাহাড়ের মানুষের জন্য এক ভয়াবহ পরিস্থিতি চলে এসেছে। ১৬ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পাঁচ শিক্ষার্থী অপহৃত হওয়ার ঘটনা দেশের জনগণের মধ্যে এক গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর, সবার মনে একটাই প্রশ্ন—পাহাড়ে চলমান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কখন থামবে? অপহৃতরা মুক্তি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু এটি কি পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের শেষ অঙ্ক? বাস্তবতা বলছে, পরিস্থিতি যতই সংকটমুক্ত হোক, পাহাড়ে অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সংস্কৃতি বন্ধ হতে যাচ্ছে না।
পাহাড়ের সন্ত্রাসী দলগুলোর অপরাজনীতি: সাধারণ মানুষের শোষণ ও নির্যাতন
পাহাড়ের এই সহিংসতা শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মাধ্যম নয়, বরং এটি মানুষের জীবনে এক অবর্ণনীয় আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। অপহৃত শিক্ষার্থীরা ছিলেন সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পিসিপির সদস্য, আর অপহরণকারীরা ছিল প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের সদস্য। একটি অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি করে, এই দুই সন্ত্রাসী দল নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সাধারণ জনগণকে ব্যবহার করছে। দুই দলের মধ্যকার অপরাজনীতির কারণে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ আজও এক ভীতিকর পরিস্থিতিতে বসবাস করছে।
এই সন্ত্রাসী দলগুলোর অপরাজনীতি শুধু তাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্য, বরং পুরো পাহাড়ি জনগণের জীবনে এক বিশাল সংকট তৈরি করছে। পাহাড়ের সাধারণ জনগণ এবং প্রশাসন বারবার এই অপরাজনীতির শিকার হচ্ছে। সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়মিত কঠোর অভিযান ছাড়া যে তীব্র অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা পাহাড়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য এক কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপহরণ, খুন ও চাঁদাবাজির সংস্কৃতি: কখন থামবে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড?
পাহাড়ের সন্ত্রাসী দলগুলো যে শুধু নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সহিংসতা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, তা নয়, তারা দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে জনগণের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি—এই সব অপরাধ প্রতিনিয়ত পাহাড়ে ঘটছে। এসব কার্যকলাপ শুধুমাত্র এক রাজনৈতিক পক্ষের ক্ষতি করতে নয়, বরং সাধারণ মানুষ, পাহাড়ি-বাঙালি সকল শ্রেণির মানুষের জন্য এক বিশাল বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক অপহরণের ঘটনায়, যখন সেনাবাহিনী তাদের অভিযানে সফল হয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করেছে, তখন মানুষ কিছুটা শান্তি পেয়েছে। কিন্তু একটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে—এত দ্রুত মুক্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের মত হাজারো মানুষ এর আগে কিংবা পরেও এই অপহরণের শিকার হবে না তো? কেন এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থামবে না?
সেনা হঠানোর কথা বলা লোকজন সেনাবাহিনীর সহায়তা কামনা করছে!
অপহরণের পরপরই, এমন একটি বাস্তবতা উঠে এসেছে, যা পাহাড়ের পরিস্থিতির দ্বৈততা এবং কিছু রাজনৈতিক বক্তব্যের অসংগতি তুলে ধরেছে। দীর্ঘদিন ধরে যারা পাহাড় থেকে সেনা হঠানোর দাবি জানিয়ে আসছিল, যারা সেনাবাহিনীকে ‘অবাঞ্ছিত’ ও ‘অপরাধী’ হিসেবে চিত্রিত করছিল, তারাই এখন সেনাবাহিনীর সহায়তা কামনা করছে। এই অপহরণ ঘটনার পর, এমনকি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর তৎপরতা প্রচণ্ডভাবে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
এটা স্পষ্ট করে তোলে যে, সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছাড়া পাহাড়ের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যখন সন্ত্রাসী দলগুলো সাধারণ জনগণের ওপর হামলা চালাচ্ছে, তাদের অপহরণ করছে, তখন সেই সেনাবাহিনীরই প্রয়োজন পড়ে, যাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছিল।
এই দ্বৈত মানসিকতা এবং রাজনীতি পাহাড়ের সমস্যার গভীরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে একদিকে সেনাবাহিনীকে ‘অবাঞ্ছিত’ বলে অপমান করা হচ্ছে, সেখানে অন্যদিকে তাদের সাহায্য কামনা করা হচ্ছে—এটি পুরো পরিস্থিতির মিথ্যাচারের ইঙ্গিত দেয়। এর মাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যখন নিজের নিরাপত্তার প্রয়োজন পড়ে, তখন যে কৌশল বা বক্তব্যগুলি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য ব্যবহৃত হয়, তা কতটা অসঙ্গত।
সরকারের করণীয় কি?
এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু সেনাবাহিনীর তাৎক্ষনিক অভিযানই যথেষ্ট নয়, বরং একটি শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, সেনাবাহিনীকে পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার সন্ত্রাস দমনে পুর্ন ক্ষমতা দিয়ে নিয়মিত অপারেশন পরিচালনার সুযোগ দিতে হবে।
প্রথমত, সরকারকে উচিত পাহাড়ি অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা। এর জন্য সরকারকে, পাহাড়ে সেনাবাহিনীকে নিয়ে অপপ্রচারের প্রতি উপযুক্ত জবাব দিয়ে, অপপ্রচারকারীদের আইনের আওতায় এনে সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কাজে উৎসাহ প্রদান করতে হবে, যা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের উৎসগুলো শনাক্ত এবং ধ্বংস করতে সক্ষম হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরো শক্তিশালী করে সন্ত্রাসী দলগুলোর অস্ত্রের সরবরাহ বন্ধ করা জরুরি।
দ্বিতীয়ত, পাহাড়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে শান্তি ও সহাবস্থানের পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। সরকারের উচিত স্থানীয় জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা। পাহাড়ি ও বাঙালি জনগণের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলোচনা প্রক্রিয়া চালু করার মাধ্যমে এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
তৃতীয়ত, পাহাড়ে সন্ত্রাসী দলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং তাদের অর্থনৈতিক উৎসগুলো বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যে অর্থের সংগ্রহ করা হচ্ছে, তা দমন করতে হবে। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর অস্তিত্ব এবং কার্যক্রম কঠোরভাবে দমন না করা হলে, এই সহিংসতা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তার থামবে না।
মোট কথা, পাহাড়ের মানুষ এখন শান্তি এবং নিরাপত্তা চায়, তারা আর অপহরণ, খুন এবং চাঁদাবাজির মতো সহিংসতার মধ্যে বসবাস করতে চায় না। কিন্তু, এই সহিংসতা কখনোই বন্ধ হবে না যদি সরকার দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে, সরকারের উচিত সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং দীর্ঘমেয়াদী শান্তিপূর্ণ সমাধান সৃষ্টি করা। পাহাড়ের সাধারণ জনগণ আর এই অস্থিরতার মধ্যে বাঁচতে চায় না। তাদের মুক্তি ও নিরাপত্তার জন্য, সরকারের করণীয় আজ সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।