রক্তাক্ত ইতিহাস: লংগদুর উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকার হত্যাকাণ্ড ও বাঙালি নিধনের ছক

রক্তাক্ত ইতিহাস: লংগদুর উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকার হত্যাকাণ্ড ও বাঙালি নিধনের ছক

রক্তাক্ত ইতিহাস: লংগদুর উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকার হত্যাকাণ্ড ও বাঙালি নিধনের ছক
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে—রক্তাক্ত এক বৃহস্পতিবার। মাহে রমজানের শেষ দশক, গোধূলির শান্ত আকাশে সূর্য তখনও অস্ত যায়নি। ঠিক সেই সময়ে রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় সংঘটিত হয় এক নির্মম হত্যাকাণ্ড—যা কেবল একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতার জীবন শেষ করেনি, বরং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি নেতৃত্ব ও অস্তিত্বের উপর চালিয়ে দেয় ভয়াবহ আঘাত। এদিন সশস্ত্র শান্তিবাহিনীর গুলিতে নিহত হন লংগদু উপজেলার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকার।

একজন নেতৃত্বগুণে অভিসিক্ত জননেতা

আব্দুর রশিদ সরকার ছিলেন বাগেরহাট জেলার স্মরণখোলা থানার মৃত আব্দুল গনি হাওলাদারের পুত্র। ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত এই মানুষটি শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও, একসময় পটুয়াখালী থেকে বেরিয়ে আসেন বৃহত্তর দায়িত্বে। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন। হাজি ক্যাম্প থেকে আগত লোকদের মাঝে তাকে লংগদু উপজেলার ইয়ারাংছড়ি এলাকায় গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে পাঠানো হয়। স্থানীয় বাঙালিদের পাশে থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও নেতৃত্বদানের ফলে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

১৯৮১ সালে তিনি লংগদু সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং পরে ১৯৮৫ সালে বিপুল ভোটে প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। তাঁর সততা, নেতৃত্বগুণ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁকে এক প্রিয় মুখে পরিণত করে।

শান্তিবাহিনীর হিংস্রতা ও পরিকল্পিত আক্রমণ

তৎকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় ছিল শান্তিবাহিনী নামধারী একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এরা দীর্ঘদিন ধরে বাঙালি উচ্ছেদে নানা সহিংস কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। আব্দুর রশিদ সরকার তাদের চাঁদাবাজি ও দমননীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ছিলেন। শান্তিবাহিনীর ডাকে সাড়া না দেওয়া, বাঙালি সংগঠন থেকে সরে না দাঁড়ানো এবং পাহাড়ে বাঙালিদের অধিকার আদায়ে সরব থাকার কারণে তারা তাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।

মাইনি বাজার সফর শেষে নিজ বাসায় ফেরার পথে লংগদু উপজেলার কাঠালতলা এলাকায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার শরীরে ১০টি বুলেট ঢুকে যায়। পবিত্র রমজানের ২৭তম দিবসে, ইফতারের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে, নিঃশব্দে নিভে যায় এক অক্লান্ত কর্মীর প্রাণ—যিনি পাহাড়ি জনপদে বাঙালির মুখপাত্র ছিলেন।

লংগদু গণহত্যা ও রাষ্ট্রীয় নীরবতা

এই ঘটনাটি শুধু আব্দুর রশিদ সরকারের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের উপর দীর্ঘদিনের সহিংস রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা। হত্যা পরবর্তী সময়ে শান্তিবাহিনী পুনরায় গুলি চালিয়ে বহু নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে। ইতিহাসে এই ঘটনা ‘লংগদু গণহত্যা’ নামে পরিচিত।

গবেষণায় দেখা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ছোট-বড় প্রায় ৪৬টি গণহত্যার তথ্য পাওয়া যায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই লক্ষ্য একটাই—পার্বত্য অঞ্চল থেকে বাঙালিদের চিরতরে উচ্ছেদ করা। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, দীর্ঘ তিন যুগ পার হলেও আজ পর্যন্ত আব্দুর রশিদ সরকারসহ এইসব হত্যাকাণ্ডের কোনও বিচার হয়নি।

শান্তিচুক্তির আড়ালে দায়মুক্তি?

১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর শান্তিবাহিনী নাম পাল্টে নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করলেও, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও ইতিহাস বিকৃতির ধারা অব্যাহত রেখেছে। মানবাধিকার ও ইতিহাস রক্ষার নামে তারা আজও মিথ্যাচার করে যাচ্ছে—যেখানে বাস্তবতার বিপরীতে তারা নিজদের ‘অত্যাচারিত’ প্রমাণ করতে চায়। অথচ হকের দাবিতে আন্দোলনকারী এক জনপ্রিয় চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, শুধুমাত্র তিনি বাঙালির পক্ষে কথা বলেছিলেন বলেই।

পরিবারের ক্ষোভ ও দাবির অপেক্ষা

আব্দুর রশিদ সরকারের দুই স্ত্রী ও চার সন্তান এখনো তার হত্যার সুবিচার পাননি। তাদের দাবি, কেবল পারিবারিক ক্ষতিপূরণ নয়, জাতির পক্ষ থেকেও এই হত্যার যথাযথ স্বীকৃতি এবং বিচার হওয়া প্রয়োজন।

রাষ্ট্রের প্রতি দাবি

১. লংগদুতে আব্দুর রশিদ সরকার হত্যাকাণ্ডসহ সকল বাঙালি নিধনের তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
২. ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩. শান্তিচুক্তির বিতর্কিত ধারাগুলো পর্যালোচনা করে দেশের সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান অনুযায়ী সংশোধন করতে হবে।
৪. পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদারে সেনা সদস্য বৃদ্ধি করতে হবে।

আব্দুর রশিদ সরকারের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ইতিহাসকে বিকৃতির আগুনে পোড়ানো যাবে না। তাঁর ত্যাগ আমাদের কাছে কেবল স্মৃতি নয়—চেতনার দীপ্ত মশাল। পার্বত্য চট্টগ্রামে সহাবস্থান ও শান্তির ভিত্তি গড়ে তুলতে হলে, সন্ত্রাসের শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে—আর সেটি শুরু হবে ন্যায়ের দাবির বাস্তবায়ন থেকেই।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।