রোহিঙ্গাদের ঠেলে পাঠাচ্ছে ভারত, বাড়ছে উদ্বেগ

রোহিঙ্গাদের ঠেলে পাঠাচ্ছে ভারত, বাড়ছে উদ্বেগ

রোহিঙ্গাদের ঠেলে পাঠাচ্ছে ভারত, বাড়ছে উদ্বেগ
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

আক্কাসুর রহমান প্রায় এক বছর আগে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যান ভারতের ত্রিপুরায়। দুদিন আগে আক্কাসের পরিবারসহ ১২ রোহিঙ্গাকে মৌলভীবাজারের কুমারশাইল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশি বলে পুশইন করে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী (বিএসএফ)। তাছাড়া চারজন বাংলাদেশিকেও একই সময় ঠেলে পাঠানো হয়। এর আগেও দেশের বিভিন্ন স্থানে সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশি নাগরিক আখ্যা দিয়ে পুশইন করেছে ভারত।

গত তিন মাসে দেড় হাজারের বেশি নারী-পুরুষ ও শিশুকে পুশইন করা হয়েছে। তার মধ্যে একশর বেশি রোহিঙ্গা নাগরিক রয়েছে বলে পুলিশের একটি গোপন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। মিয়ানমার থেকে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা ভারতের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে গেছে বলে তথ্য এসেছে।

জানা গেছে, পুশইন বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, বাংলাদেশের শান্ত পরিবেশকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছে প্রতিবেশী দেশটি। বাংলাদেশ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, আলোচনা ছাড়া কাউকে পুশইন না করাতে। কিন্তু এসব অনুরোধ পাত্তাই দিচ্ছে না তারা।

তাছাড়া উত্তপ্তের শঙ্কার পেছনে কাজ করছে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা। ইতিমধ্যে একটি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছে, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বড় ধরনের নাশকতা চালানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি গভীর উদ্বেগের বিষয়। এটি চূড়ান্তভাবে সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলছে। এভাবে চলতে থাকলে ভারত পুশইনের সুযোগ নিয়ে কোনো বড় অপরাধীকেও পাঠাতে পারে। বাংলাদেশও ভারতে পুশব্যাক করার চিন্তা করতে পারে এখন। বাংলাদেশে অনেক ভারতীয় নাগরিক আছেন, যাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। তাদের বিষয়ে নজরদারির আওতায় আনতে হবে দ্রুত সময়ে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার না পাঠিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হচ্ছে। এতে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থাকবেই।

নদীতেও ফেলে দেওয়া হচ্ছে লোকজনকে 

পুলিশের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪১ বছর বয়সী সেলিনা বেগম জানান, ২২ মে খাগড়াছড়ির রামগড়ে ফেনী নদীতে ফেলে দেয় বিএসএফ। উদ্ধারের আগে তিনি এবং তার স্বামীসহ তিন মেয়ে সারারাত পানিতে ভেসেছিলেন। তাদের সঙ্গে শুধু ছিল খালি প্লাস্টিকের বোতল। এটি ধরে কোনোরকম জীবন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করেছে ভারত। তারা বৈধভাবেই ভারতে গিয়েছিলেন। তারা তাদের তিন দিন ধরে খাবার ও পানি ছাড়া আটকে রেখেছিল। তারপর সীমান্তে নিয়ে যায়।

সেলিনা বেগম আরও বলেন, ‘আমার বাচ্চারা জানত না কী ঘটছে। আমরা সারারাত ভেসেছিলাম। আমাদের কেউই সাঁতার জানতাম না। স্বামী উম্মেদ আলী (৪৭) এবং তিন মেয়ে রুমি খাতুন (১৬), রুম্পা খাতুন (১৫) ও সুমাইয়া খাতুনকে (৬) নিয়ে হরিয়ানা এলাকায় বসবাস করে আসছিলাম। একটি কারখানায় আমরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করি। হঠাৎ করেই ভারতের লোকজন আমাদের আটক করে সীমান্ত এলাকায় নিয়ে আসে। হরিয়ানাসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে অন্তত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আছে। তারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে ভারত চলে যায়। তাদেরও ধরে ধরে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। প্রায় ১০ বছর ভারতে ছিলাম।’

ভিনদেশিদের বিষয়ে ভারতে আইন যা বলা আছে 

ভারতীয় আইন অনুযায়ী, বিদেশ থেকে কেউ যদি পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া ভারতে আসেন, তাহলে তাকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হয়। এরপর বিদেশি আইনের ১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী মামলা হয়। মামলায় যদি সেই ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে তার সাজা হবে। সাজার শেষে আদালতের মাধ্যমেই যেই ব্যক্তি যে দেশ থেকে এসেছেন, সেখানে ফেরত পাঠানো হবে। কিন্তু এসব কিছুর তোয়াক্কা না করে পুশইনের অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেই চলেছে বিএসএফ।

সুন্দরবন দিয়েও পুশইন 

গত ৯ মে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ৭৮ জনকে ফেলে যায় বিএসএফ। পরে তাদের আটক করে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। পুলিশ বলছে, তাদের মধ্যে ৭৫ জন বাংলাদেশি ও তিনজন ভারতীয় নাগরিক। উদ্ধারদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, তাদের গুজরাট থেকে উড়োজাহাজ-লঞ্চে করে চোখ বেঁধে আনা হয়েছে, অনেকে অসুস্থ এবং কারও কারও শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন আছে।

৭ মে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে পুশইন করানোর পর ১২৩ জনকে আটক করে বিজিবি। তাদের মধ্যে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা, শান্তিপুর ও পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী ব্যক্তিরাও জানান, তাদের গুজরাট থেকে উড়োজাহাজে করে প্রথমে ত্রিপুরায় নিয়ে আসেন বিএসএফ সদস্যরা। তারপর এক ঘণ্টা হাঁটিয়ে সীমান্ত দিয়ে এই পাড়ে ঠেলে দেওয়া হয়। এদের ভেতর বাংলা ভাষাভাষী ছাড়াও রোহিঙ্গা ও গুজরাটি ভাষায় কথা বলা মানুষও আছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা যা বললেন 

নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, সম্পর্কে চিড় ধরায় বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে ‘পুশইন’ তৎপরতা চালাচ্ছে ভারত। এই অবস্থায় পুশইন হওয়াদের মধ্যে যারা বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন, তাদের গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নেই। তবে অধিকাংশের কাছে কোনো তথ্য-প্রমাণ না থাকায় একটি জটিলতা তৈরি হবে। এ ক্ষেত্রে যাদের পুশইন করা হয়েছে তাদের কেউ ভারতীয় নাগরিক হলে বাংলাদেশও পুশব্যাক করবে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছে। তবে এ বিষয়গুলো সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে দুই দেশের সম্পর্কের উন্নতি হলে পুশইন থেমে যাবে।’

পুশইন বন্ধ করতে ভারতের কাছে চিঠি 

পুশইন বেড়ে যাওয়ায় গত ৯ মে ভারত সরকারে কাছে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ। চিঠিতে বলা হয়, কোনো ব্যক্তির বাংলাদেশি নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর বিদ্যমান প্রক্রিয়া মেনে বাংলাদেশ তাদের ফেরত নেবে। এর ব্যত্যয় হলে দুই দেশের বোঝাপড়ার মধ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। একইভাবে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশের পরিবর্তে তাদের আদি নিবাস মিয়ানমারেই ফেরত পাঠানো উচিত ভারতের। কোনোভাবে ভারতীয় নাগরিকদের জোর করে বাংলাদেশে পুশইন করাটা উচিত হবে না। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে এ ধরনের পুশইন অগ্রহণযোগ্য এবং তা পরিহার করা উচিত।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।