পার্বত্য চট্টগ্রামে বাজারফান্ড জমি নিয়ে প্রশাসনিক জট, ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাজারফান্ড জমি নিয়ে প্রশাসনিক জট, ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাজারফান্ড জমি নিয়ে প্রশাসনিক জট, ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা—রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বাজারফান্ড জমি নিয়ে প্রশাসনিক জটিলতার কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাজারফান্ড জমি মর্টগেজ (বন্ধক) দিয়ে ঋণ নিতে না পারায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা অর্থ সংকটে ভুগছেন। এতে ব্যবসার পরিধি ছোট হচ্ছে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না, বাড়ছে বেকারত্ব। একই সঙ্গে এখানকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে।

ব্যবসা সংকোচন ও হতাশা বাড়ছে

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, শহরকেন্দ্রিক বাজারফান্ড জমির দাম বেশি হলেও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে ব্যাংক ঋণ মিলছে না। ফলে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হচ্ছেন মূলধন সংকটে পড়তে। অনেকে ইতোমধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছেন। নতুন উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিতে পারছেন না, কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হচ্ছে না।

রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি অ্যাডভোকেট মামুনুর রশিদ বলেন, “২০১৭ সালে রাঙামাটির তৎকালীন জেলা প্রশাসক প্রথমবার বাজারফান্ড এলাকার ভূমি রেজিস্ট্রির মিউটেশন মামলা স্থগিত করেন। তখন নানা দেন-দরবারের পর তা চালু হলেও ২০১৯ সালে আবার বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ব্যবসায়ীরা ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা দ্রুত এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাই।”

প্রশাসনিক জটের শুরু

বাজারফান্ড জমি নিয়ে মূল জটিলতা শুরু হয় ২০১৭ সালে, যখন রাঙামাটির তৎকালীন জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান ঋণ চুক্তি রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পরবর্তীতে খাগড়াছড়ির তৎকালীন জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস ২০১৯ সালে বাজারফান্ড বন্দোবস্তি জমিকে “খাস জমি” আখ্যা দিয়ে ঋণ প্রদানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চান।

তার পদক্ষেপ অনুসরণ করে রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলা প্রশাসকরাও একইভাবে ঋণ চুক্তি রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম স্থগিত করে দেন। ফলে একযোগে তিন পার্বত্য জেলায় ব্যবসায়ীরা বাজারফান্ড জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়ার সুযোগ হারান।

আইন কী বলে?

১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ১২ (২) ধারা অনুযায়ী, ঋণগ্রহীতা ও ব্যাংকের মধ্যে চুক্তি রেজিস্ট্রেশন করার এখতিয়ার জেলা প্রশাসকের। তবে বাজারফান্ডের জমি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা জেলা পরিষদের।

১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির পর প্রণীত জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী বাজারফান্ড জেলা পরিষদের অধীনে ন্যস্ত। অর্থাৎ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হচ্ছেন বাজারফান্ড প্রশাসক। তিনি ভূমি বন্দোবস্তের ক্ষমতা রাখলেও জেলা প্রশাসক কেবল রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্বে আছেন। তাই জেলা প্রশাসন আইনত বাজারফান্ড জমি বন্ধক প্রক্রিয়া আটকে রাখতে পারেন না।

রাঙামাটি জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানান। তার মতে, বাজারফান্ড জমি স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত প্রদানের নিয়ম বিদ্যমান এবং কবুলিয়ত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এসব জমি বন্ধক দেওয়ার অনুমোদন রয়েছে।

ব্যাংকগুলোর লোকসান

প্রশাসনিক জটের কারণে কেবল ব্যবসায়ীই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, ব্যাংকগুলোরও ক্ষতি হচ্ছে। রাঙামাটিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ১৭টি ব্যাংক প্রতিদিন গড়ে ৫০–৬০ কোটি টাকার লেনদেন করে। কিন্তু বাজারফান্ড জমি বন্ধক গ্রহণ করতে না পারায় বছরে অন্তত ১০০ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো।

রাঙামাটির সোনালী ব্যাংক প্রিন্সিপাল শাখার ব্যবস্থাপক সাদ উল্লাহ বলেন, “বাজারফান্ড জমির আইনি জট না মেটায় এসব জমি মর্টগেজ নেওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেক ব্যবসায়ী ঋণ পাচ্ছেন না, ব্যাংকও বিনিয়োগ করতে পারছে না।”

প্রতিক্রিয়া ও সমাধানের আশা

সাবেক এমপি ও উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াদুদ ভূঁইয়া বলেন, “বাজারফান্ড জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া দীর্ঘদিনের প্রথা। হঠাৎ জেলা প্রশাসকদের এই সিদ্ধান্ত রহস্যজনক। এটি কোনো অদৃশ্য শক্তির নীলনকশা হতে পারে।”

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

গত ৯ জুলাই রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহর সঙ্গে ‘বাজারফান্ড ভূমি অধিকার সংরক্ষণ কমিটি’ বৈঠক করেছে। বৈঠকে ডিসি ভূমি জটিলতা নিরসনে সহযোগিতার আশ্বাস দেন এবং বিষয়টি উচ্চপর্যায়ে তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দেন।

উল্লেখ্য, বাজারফান্ড জমি নিয়ে প্রশাসনিক জটিলতা যতদিন অবসান না হবে, ততদিন পাহাড়ের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হতে থাকবে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, সরকার দ্রুত উদ্যোগ নেবে এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধান বের করবে।

-পার্বত্য নিউজ।