পাহাড়ে বাঙালি নাগরিকদের অধিকার বৈষম্য: ১৬ হাজার টাকার এক সনদে অসহায়ত্বের নির্মম চিত্র

পাহাড়ে বাঙালি নাগরিকদের অধিকার বৈষম্য: ১৬ হাজার টাকার এক সনদে অসহায়ত্বের নির্মম চিত্র

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

✍️ মোঃ সাইফুল ইসলাম

সংবিধান বলে—রাষ্ট্রের সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান হবেন এবং সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। বাস্তব চিত্র কিন্তু ভয়াবহভাবে ভিন্ন। পাহাড়ে জন্মানো মুসলিম বাঙালি নাগরিকদের জন্য এই সমতার বিধান যেন কাগুজে বুলি ছাড়া আর কিছু নয়। বান্দরবানের আলীকদমের আসমাউল হুসনার অভিজ্ঞতা এই বৈষম্যের এক নির্মম দলিল। সেই অভিজ্ঞতাই নিজ ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করেছেন তিনি। তাঁর লেখা পড়লে বোঝা যায়, একটি সনদ কতটা নিছক কাগজের টুকরো হয়ে দাঁড়াতে পারে, আর কতটা নির্মম বৈষম্যের প্রতীক হতে পারে।

২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় তিনি পার্বত্য কোটা সুবিধা ভোগের লক্ষ্যে বোমাং সার্কেল চীফ কার্যালয় থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটি স্থানী বাসিন্দা সনদ সংগ্রহ করেন। সেই সনদ পেতে তাঁকে গুনতে হয়েছে ১৬ হাজার টাকা—যা ছিল তার পরিবারের জন্য এক বিশাল চাপ। অথচ বাস্তবে দেখা গেল, ওই সনদ কোনো কাজে আসেনি। কারণ, কোটা সুবিধা পাওয়ার জন্য বাধ্যতামূলক শর্ত হিসেবে জেলা প্রশাসকের প্রদত্ত স্থায়ী বাসিন্দা সনদ প্রয়োজন।

এখানেই লুকিয়ে আছে বৈষম্যের মূল। স্থায়ী বাসিন্দা সনদ পেতে হলে মুসলিম নাগরিকদের জমি খতিয়ানভুক্ত থাকতে হয়। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নাগরিকদের জন্য এই শর্ত প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ একই ভূখণ্ডে জন্ম নিলেও জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র দুটি আলাদা মানদণ্ড প্রয়োগ করছে। এই প্রশ্নের উত্তর আজও রাষ্ট্র দিতে পারেনি।

আসমাউল হুসনার আরেকটি কষ্টের জায়গা হলো—এই সনদ সংগ্রহ করতে তাঁকে ১৬ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। ভর্তি মৌসুমে যেখানে শিক্ষার্থীর মনোযোগ থাকার কথা পড়াশোনার প্রস্তুতিতে, সেখানে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে অযৌক্তিক প্রথার সঙ্গে। শুধু টাকার চাপ নয়, মানসিকভাবে তিনি হয়েছেন নিপীড়িত। একটা অকার্যকর সনদ হাতে নিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছেন—রাষ্ট্র তাঁকে নাগরিক হিসেবে কতটা গুরুত্ব দেয়।

বিশ্বের অনেক দেশে জন্ম নেওয়ার মাধ্যমেই নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। এমনকি বাবা-মাকেও স্থায়ী বসবাসের অধিকার দেওয়া হয়। অথচ বাংলাদেশে পাহাড়ে জন্ম নিয়েও বাঙালি শিক্ষার্থীরা কেবল জমির কাগজ দেখাতে না পারায় নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। রাষ্ট্রের এই বৈষম্য শুধু একটি প্রজন্মকে হতাশ করছে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে পাহাড়ে বিভাজন ও অসন্তোষ তৈরি করছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে: “সকল নাগরিক আইনসম্মুখে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী হইবেন।”

পাহাড়ে বাঙালি নাগরিকদের অধিকার বৈষম্য: ১৬ হাজার টাকার এক সনদে অসহায়ত্বের নির্মম চিত্র

৩১ অনুচ্ছেদে বলা আছে: “বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক আইনের আশ্রয় লাভের সমান অধিকারী হইবেন।”

কিন্তু পার্বত্য এলাকায় স্থায়ী বাসিন্দা সনদের ক্ষেত্রে ভিন্ন মানদণ্ড আরোপ করে রাষ্ট্র কার্যত এই অনুচ্ছেদগুলোর লঙ্ঘন করছে।

এছাড়া ২৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, “রাষ্ট্র কেবল ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।” কিন্তু পাহাড়ে মুসলিম বাঙালিদের জন্য জমির খতিয়ান শর্ত রাখা এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তা বাদ দেওয়া সরাসরি বৈষম্য নয় কি?

এমন বৈষম্যমূলক নীতি শুধু একজন শিক্ষার্থীর জীবনকে দুঃসহ করে না, বরং রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ধ্বংস করে। আসমাউল হুসনার মতো শিক্ষার্থীরা বুঝে যাচ্ছে—রাষ্ট্র তাদের সমান নাগরিক হিসেবে মানতে অনিচ্ছুক। দীর্ঘমেয়াদে এর ফলে পাহাড়ে বিভাজন ও ক্ষোভ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই, অনেক দেশে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। এমনকি বাবা-মাকেও সেখানে স্থায়ী বসবাসের অধিকার দেওয়া হয়। অথচ আমাদের দেশে পাহাড়ে জন্ম নেওয়া মুসলিম বাঙালিরা জমির কাগজ দেখাতে না পারলে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। এটি স্পষ্টতই বৈষম্য এবং সংবিধানবিরোধী।

যে বৈষম্যের কারণে আসমাউল হুসনার মতো শিক্ষার্থীরা চোখের জলে ভর্তি পরীক্ষা দেয়, সেই বৈষম্য চলতে থাকলে সংবিধানে লেখা নাগরিক সমতার শপথ কেবল মুখস্থ বাণী হয়েই থাকবে। রাষ্ট্রকে অবশ্যই দ্রুত এ প্রথা সংস্কার করতে হবে। পাহাড়ে জন্ম নেওয়া প্রতিটি নাগরিকের জন্য স্থায়ী বাসিন্দা সনদের ক্ষেত্রে একই মানদণ্ড প্রযোজ্য করতে হবে।

কারণ নাগরিক অধিকার কোনো দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়, এটি জন্মসূত্রে অর্জিত অধিকার। একই ভূখণ্ডে জন্মানো দুই সন্তানের জন্য আলাদা নিয়ম শুধু সংবিধান লঙ্ঘন নয়, রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।

আসমাউল হুসনার কষ্টের গল্প কেবল একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়; এটি পাহাড়ে মুসলিম বাঙালিদের ওপর আরোপিত দীর্ঘদিনের বৈষম্যের প্রতিফলন। রাষ্ট্র যদি সত্যিই সমতা ও ন্যায়বিচারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, তবে এই বৈষম্য দূর না করে কোনো বিকল্প নেই।

উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে এই ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। অতীতে বহুবার স্থানীয় বাঙালি শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কিংবা সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। একাধিকবার আদালত ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও বৈষম্যমূলক প্রথা আজও বহাল আছে।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

You may have missed