প্রকৃতি প্রেমি শাহরিয়ার সিজার ও স্বার্থান্বেষী মহলের অপপ্রচার - Southeast Asia Journal

প্রকৃতি প্রেমি শাহরিয়ার সিজার ও স্বার্থান্বেষী মহলের অপপ্রচার

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

ফিচার ডেস্ক

শাহরিয়ার রহমান সিজার, এক ধর্নাঢ্য পরিবারের সন্তান। সাবেক যুগ্ন সচিব বাবার এই সন্তানের ছোটবেলা থেকেই পশু-পাখি তথা প্রাণীদের প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসা কাজ করতো। তারই ফলশ্রুতিতে জীববিজ্ঞান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গিয়ে মাথায় ঢুকে গেল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের চিন্তা। ফিরে এলেন দেশে। নেমে পড়লেন বিলুপ্ত প্রাণীর সন্ধানে। তার মাথায় কাজ করছিলো বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের কিভাবে টিকিয়ে রাখা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ শুরু হয়েছিল ঘোরাঘুরির ফাঁকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সৌন্দর্য টানত শাহরিয়ার সিজার রহমানকে। মাঝে মধ্যেই যেতেন সেখানে। চিন্তা করলেন গবেষণার পরিধি এ এলাকায় বিস্তৃত করলে কেমন হয়। এর মধ্যে তার সঙ্গে যোগ দিলেন আরও কিছু সমমনা বন্যপ্রাণী গবেষক। যার যার কাজগুলো ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স বা সিসিএ নামে এক প্লাটফরমে আনার চেষ্টা করলেন তারা। প্রথমে কচ্ছপ নিয়ে গবেষণা শুরু হলো। যার ফলে প্রথমবারের মতো দেশের মাটিতে আরাকান ফরেস্ট টার্টেল নামে অতি বিরল প্রজাতির এক কচ্ছপের সন্ধান পেলেন তারা। এ এলাকায় কাজ করতে করতে ক্রমে তাদের সামনে উন্মোচিত হতে লাগল প্রাণীবৈচিত্র্যের এক নতুন দ্বার।

ঢাকার বাসিন্দা শাহরিয়ার সিজার ২০১০ এর পর একসময় পর্যটন নগরী বান্দরবানে ঘুরতে যায়, থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের বড় মদক, ছোট মদক,ও লেক্রি সীমানা পর্যন্ত। গহিন অরণ্যের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে সে বুঝতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রাণীজগতের এক অপূর্ব ভান্ডার। এ সম্পদকে টিকিয়ে রাখতে হবে।

শুরুতে বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদম ও থানচি এলাকার স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের লোকজনকে বিলুপ্ত প্রায় কচ্ছপ না মারা ও খাবারের তালিকা থেকে কচ্ছপ বাদ দেয়ার কাজে নেমে পড়েন তরুন প্রকৃতি প্রেমী শাহরিয়ার সিজার। শুরুতে এ কাজে অনেকটা বেগ পেতে হলেও পরবর্তীতে স্থানীয়দের কচ্ছপ না মেরে সংরক্ষনের বিনিময়ে একটি করে মুরগী প্রদান ও কচ্ছপ আমাদের প্রাণীকুলের বাস্তুসংস্থানের জন্য কতটা উপকারী তা বুঝাতে সক্ষম হন তিনি। ২০১১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় তৃণমূল প্রাণী সংরক্ষণে নিজের প্রকল্পের কাজ শুরু করেন শাহরিয়ার। প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে তার দল এশিয়ার বৃহত্তর কচ্ছপটি উদ্ধার করে। আগে এ প্রজাতিটিকে বিলুপ্ত বলে মনে করা হয়েছিল।

ছবি-১: লন্ডনের রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটিতে আয়োজিত হোয়াইটলি অ্যাওয়ার্ডসের ২৫তম বার্ষিকীতে ‘হোয়াইটলি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করছেন সিজার

পরবর্তীতে সিজার কচ্ছপ নিয়ে গবেষণা ও এর জাত টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অবদান রাখায় পেয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্মাননাও। ২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল লন্ডনের রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটিতে আয়োজিত হোয়াইটলি অ্যাওয়ার্ডসের ২৫তম বার্ষিকীতে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর তৃণমূল প্রাণী সংরক্ষণে কাজ করার জন্য সম্মানিত ‘হোয়াইটলি অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন বাংলাদেশের এ তরুণ।

এ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার বর্ননা দিয়ে সিজার বলেন, ‘আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল এলাকায় এখনও কিছু জায়গা আছে যা সত্যিই দুর্গম। শহর থেকে লটবহর নিয়ে গিয়ে সেখানে গবেষণা কাজ চালানো সহজ না। তাই চিন্তা করলাম স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের লোকজনকে দিয়ে সংরক্ষণের কাজ করতে হবে। তাও সহজ ছিল না। প্রথমে তাদের বিশ্বাস করাতে হয়েছে যে আমরা কোনো ক্ষতি করতে আসিনি বরং এতে তাদের লাভ হবে। এ ছাড়া এসব বন্যপ্রাণী তারা শিকার করে খেত। শিকারি থেকে তাদের আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি সংরক্ষক বানাতে। আমার এমন বহু অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, কোনো পাড়ায় গিয়ে কথা বলছি এমন সময় কেউ হয়তো বলল অমুক প্রাণী তো কয়েকদিন আগেই শিকার করেছি বা একে কয়েকদিন আগে বনে দেখেছি। তারা এসব প্রাণীর হাড়গোড় বা চামড়া দেখাতে লাগল। প্রথমে আমরা তাদের কিছু ক্যামেরা দিলাম। বলা হলো এরকম কোনো পশু-পাখি দেখলেই তারা যাতে ছবি তুলে রাখে। তার ফল এলো অভূতপূর্ব। কয়েক মাস পরে দেখলাম, তারা যেসব প্রাণীর কথা বলছে তার বেশির ভাগই দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরপর আমরা এসব জনগোষ্ঠীকে সংরক্ষণের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও ক্যামেরা এবং যন্ত্রপাতি দিলাম।’

২০১১ সালে বান্দরবানে এক বড় মদনটাক পাখি দেখে বাংলাদেশের দুর্লভ বন্য প্রাণীর খোঁজ করায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি দেশের বন্য প্রাণীদের রক্ষা যেমন করতে চান, তেমনি এদের কথা জানাতে চান বিশ্বকে। বাংলাদেশে এত বড় পাখি আছে ভাবতেই সিজারের গর্বে বুকটা ভরে গেল। মনে হলো আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের বন্য প্রাণীদের জগৎটা এখনো উন্মোচিত হয়নি। এই সম্পদের খোঁজ নিতেই শুরু করেন বান্দরবানের পাহাড়ে-জঙ্গলে, ছড়ায় ঘুরে বেড়ানো। বন্য প্রাণীর খোঁজ করা ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে সিজার ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু-শিক্ষক মিলে গড়ে তুলেছেন ‘ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স’ নামের একটি সংগঠন। পার্বত্য এলাকায় তাঁরা চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও গড়ে তুলেছেন, যেখানে সাধারণ পাঠ্যক্রমের সঙ্গে প্রাণী সংরক্ষণের বিষয়ও পড়ানো হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে আভিযানিক যাত্রায় শাহরিয়ারের হাতে এমন কিছু রেকর্ড এসেছে যা অনেকেরই অজানা ছিলো। যেসব প্রাণী বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হতো সেসব প্রাণীর সন্ধান দিয়ে একে একে বনবিভাগকে চমকে দিলো সিজার। বলা হলো গাউর বা ভারতীয় বনগরু বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু সিসিএর সহায়তায় স্থানীয় ক্ষুদ্রনৃ-গোষ্ঠীদের বসানো ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরা পড়েছে গাউরের ছবি। তার মানে এ প্রজাতি এখনও এ ভূখণ্ডে আছে। শুধু কি গাউর? সান বিয়ার বা সূর্য ভাল্লুক নামে ভাল্লুকের একটি প্রজাতিকেও খুঁজে পেলেন তারা। এছাড়া মেঘলা চিতা বা ক্লাউডেড লেপার্ড, চিতা বিড়াল, মর্মর বিড়াল বা মার্বেলড ক্যাটসহ বিপন্ন অনেক প্রাণীর অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছে সিসিএর ক্যামেরা। সাম্বার হরিণ, বন্য কুকুর বা ঢোল, বন ছাগলের ছবিও উঠে এসেছে এতে। সিসিএর কর্মীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে খুঁজে পেয়েছেন বাঘের পায়ের ছাপও। ধারণা করা হচ্ছে সুন্দরবনের বাইরে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামেও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উপস্থিতি আছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত অনুসন্ধান চলছে। যে বাঘের ছাপটি পাওয়া গেছে তা প্রায় ১৩ সেন্টিমিটার।

পরবর্তীতে বাংলাদেশের বণ্যপ্রাণী এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য বিশ্বের ১৭০ জন বন্যপ্রাণী গবেষকের মধ্যে থেকে পুরষ্কারের ৩জনকে বাঁচাই করে ফিউচার ফর ন্যাচার অ্যাওয়ার্ড ফাউন্ডেশন। সেই ৩ জনের মধ্যে তরুণ জীববিজ্ঞানী ও বন্যপ্রাণী গবেষক শাহরিয়ার সিজার রহমানও পেয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ ফিউচার ফর ন্যাচার অ্যাওয়ার্ড।

অন্যদিকে তার এসব গবেষণা, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, বিলুপ্ত প্রাণীর বংশ বৃদ্ধি, প্রাণী আর মানুষের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টির কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি স্বার্থান্বেষী মহল। বান্দরবানে সিজারের প্রতিষ্ঠা করা বিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখা করে স্থানীয় শিশুরা শিক্ষিত হওয়ার বদৌলতে যেখানে তাদের খুশি হবার কথা সেখানে বিশেষ মহলটি সিজারের বিরুদ্ধে পাহাড়ে ভূমি দখল করে স্কুল ঘর নির্মাণ করা হয় বলে অভিযোগ. তুলে। এছাড়া স্থানীয় মুরং/ম্রো সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে একাত্ন হয়ে সিজারের কর্মকান্ডগুলোকে ভালো ভাবে নেয়নি পাহাড়ের অপপ্রচারকারী দলটি।

সাম্প্রতিক সময়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহরিয়ার সিজারকে বান্দরবানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষনে সহায়তার কারণে ঢাকার বেশ কয়েকটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীকে এলাকায় আসলে দেখে নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, সিজারের গবেষণাধর্মী কাজের কারণে বান্দরবানের আলীকদম ও থানচির পাহাড়ীরা বন্যপ্রাণী সংরক্ষনে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। যেখানে আগে তারা কচ্ছপ, বেজি, বন বিড়াল, হরিণসহ নানা প্রাণী হত্যা করে ভক্ষন করতো সেখানে এসব পাহাড়ীরাই আজ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল গড়ে দিচ্ছে। অপরদিকে কুচক্রি একটি মহল স্থানীয়দের ভূমি দখল করে গহীন অরণ্যে পূর্বের মতো সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে না পারায় ক্ষুব্ধ হয়ে সিজারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

তবে, নির্বিচারে বন ধ্বংস, শিকারসহ নানা কারণে বাংলাদেশের অনেক বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে চলে গেলেও শাহরিয়ার সিজার রহমান বলেন, ‘এত কিছুর পরও কিন্তু সব প্রজাতি হারিয়ে যায়নি। ৯০ ভাগ হয়তো শেষ হয়ে গেছে; ১০ ভাগ আছে। যদি বনকে আমরা আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে পারি তাহলে বন্যপ্রাণীরা আবার ফিরে আসবে। বাসস্থান ঠিক থাকলে তার বাসিন্দারা সেখানে থাকতে বাধ্য। আমাদের সামনে তো দৃষ্টান্ত আছে। আমরা যেসব এলাকায় কাজ করেছি সেখানকার মানুষ যেমন ম্রো, ত্রিপুরা তারা বেশির ভাগই শিকারি। কিন্তু শিকার বন্ধ করে তারা অনেকেই এখন সংরক্ষণের কাজ করছে আমাদের সঙ্গে। আমরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি বন্যপ্রাণী বেঁচে থাকলে তাদেরই লাভ। আসলে এই মুহূর্তে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে যে প্রথাগত পদ্ধতিতে সরকারিভাবে আগানো হচ্ছে তা কাজে দিচ্ছে না। সংরক্ষণের প্রচেষ্টা তখনই সফল হবে যখন স্থানীয় মানুষকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যাবে। কারণ তারাই বনের সবচেয়ে কাছে থাকেন। সময় এসেছে তাদের দিকে নজর ফেরাবার। আবারও বলছি, সব আশা ফুরিয়ে যায়নি। সত্যিকারভাবে কাজ করলে হারিয়ে যাওয়া প্রাণী আবার ফিরে আসবে আমাদের বনে।’