করোনা সংকটে পাহাড়ে গর্ভবতী মায়েদের ভরসার স্থল সেনাবাহিনীই
 
মোঃ সাইফুল ইসলাম
সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও আজ মহামারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। ইতিমধ্যে দেশে করোনার সংক্রমণ লাখ পেরিয়েছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই সরকার নানা ভাবে করোনার সংক্রমণ থেকে দেশবাসীকে রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবায় আগামী এক মাসের মধ্যে সারাদেশের সকল জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে আইসিইউসহ করোনা টেষ্টিং ল্যাব স্থাপনেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। এরপরও করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে বর্তমানে দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবায় ঘাটতির কথা শোনা যাচ্ছে। অন্যদিকে দুর্গমতার কারণে দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণত চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এছাড়া বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে যখন সবাই করোনার সংক্রমণ রোধে ব্যতিব্যস্ত ঠিক এই সময়টাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ অনেকটাই অন্যান্য চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। করোনা আতঙ্কে সাধারণ রোগীদের ভর্তি কিংবা কোন ধরণের সেবা দিতে নারাজ দেশের সরকারী-বেসরকারী নানা হাসপাতাল।

করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক রোগীই তাদের চিকিৎসা কিংবা চেকআপের সময়সীমা পরিবর্তন করেছেন। অনেকে রোগীই আপাতত মোবাইল ফোনে টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করছেন। কিন্তু গর্ভবতী ও সন্তান সম্ভবা নারীদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেকেই। সন্তান প্রসবের নির্দিষ্ট সময়ে এসে অনেকেই স্থানীয় হাসপাতাল থেকে কোন ধরণের চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না। অনেকেই সন্তান প্রসবকালীন চিকিৎসা সেবা নিয়ে শঙ্কিত। এমতাবস্থায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে সারাদেশের পাশাপাশি পাহাড়জুড়েও নিজেদের মেডিকেল কোরের প্রশিক্ষিত চিকিৎসকদের সমন্বয়ে এক অভিনব মেডিকেল ক্যাম্প চালু করেছে সেনাবাহিনী। করোনা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সেনাবাহিনীর এসব মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা দেয়া হয় পাহাড়ের আনাচে-কানাচে, দূর্গম এলাকাগুলোতে বসবাসরত, চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত পাহাড়ী-বাঙ্গালী গর্ভবতী ও সন্তান সম্ভবা মায়েদের। সেনাবাহিনী প্রধান জেনালের আজিজ আহমেদ’র সময়োপযোগী উদ্যোগে সারাদেশে যেভাবে গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য মেডিকেল ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে, তারই অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশন ও চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল এসএম মতিউর রহমানের সার্বিক দিক-নির্দেশনায় ইতিমধ্যেই পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে অভিনব এ চিকিৎসা সেবা ক্যাম্প পরিচালনা করেছে সেনাবাহিনী।

শুধুমাত্র সাধারণ মেডিকেল চেকআপ নয় করোনা সংকটে সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ কর্তৃক সেবা দেয়া এসব ক্যাম্পে মেডিকেল চেক-আপের পাশাপাশি দেয়া হচ্ছে নানা ধরণের ঔষধপত্র, পুষ্টিকর খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং মানবিক সহায়তার অংশ হিসেবে দেয়া হচ্ছে চাল-ডাল-তেলের সমন্বয়ে অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীও। এতে শুধুমাত্র এখানে সেবা নিতে আসা গর্ভবতী মায়েরা সেবা নিচ্ছে তা কিন্তু নয়; গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা সেবা ও ঔষধপত্রের পাশাপাশি তার পরিবারর পাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সামগ্রী।
খাগড়াছড়ি রিজিয়নের তত্বাবধানে গত ১০ জুন বুধবার পানছড়ি উপজেলার দূর্গম এলাকাগুলোতে এধরনের চিকিৎসাসেবা ক্যাম্প পরিচালনা করা হয়। চিকিৎসা সেবা প্রদানের পাশাপাশি সেখানে গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রয়োজনীয় ঔষধ প্রদান পুষ্টিকর খাবার ও খাদ্য সহায়তা বিতরণ করেছে সেনা সদস্যরা। একই দিন সেনাবাহিনীর বান্দরবান রিজিয়নের উদ্যেগে জেলা সদরের দুর্গম এলাকাগুলোতে এ মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করা হয়। গত ১৪ জুন খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়নের উদ্যোগে দীঘিনালা উপজেলার দূর্গম পাবলাখালী এলাকায় গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হয়। একই দিন বান্দরবান রিজিয়নের উদ্যেগেও একই ক্যাম্প পরিচালনা করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া ১৭ জুন বুধবার জেলার বিভিন্ন স্থানে গর্ভবতী নারীদের জন্য মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেয় সেনাবাহিনীর বান্দরবান রিজিয়ন। অন্যদিকে গত ২৪ জুন বুধবার গর্ভবর্তী মায়েদের স্বাস্থ্য সেবা ও মানবিক সহায়তা প্রদান করার অংশ হিসেবে খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়নের উদ্যোগে মহালছড়ি উপজেলার দূর্গম মহালছড়ি এলাকায় প্রায় দুই শতাধিক জন বিভিন্ন বয়সী প্রসূতি ও গাইনি রোগীদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা ও মানবিক সহায়তা প্রদান করা হয়। এসময় চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি গর্ভবর্তী মায়েদের হাতে খাদ্য সামগ্রী ও বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রীও তুলে দেয় সেনা সদস্যরা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থা বিঘ্নিত এবং দূর্গম এলাকায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছানো খুবই কষ্টসাধ্য তখন সেনাবাহিনীর এমন কর্মকাণ্ডে খুবই খুশি সাধারণ মানুষ। পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় বসবাসরত গর্ভবতী মায়েরা জানান, করোনা পরিস্থিতির কারণে অঘোষিত লকডাউন, পরিবহণ সুবিধা বা রাস্তাঘাটের অভাব ও পাহাড়ী পল্লিতে কুসংস্কারের কারণে তারা অনেকেই গর্ভাবস্থায় চিকিৎসা সেবা ও পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হবার উপক্রম হয়েছিলো, কিন্তু সেনাবাহিনীর মানবিকতায় তারা যেন নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছেন।

পাহাড়ের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত এসব মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী চিকিৎসকগণ জানান, গর্ভাবস্থায় একজন মা ঠিকমতো স্বাস্থ্যসেবা, ঔষধপত্র ও পরিমানমতো পুষ্টিকর খাবার না পেলে মা এবং তার অনাগত সন্তানের জন্য তা মারাত্নক ক্ষতির কারণ হড়ে দাঁড়াতে পারে। তাই করোনা সংকটকালে পাহাড়ে সুবিধাবঞ্চিত গর্ভবতী এসব মায়েদের ও তাদের অনাগত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই পাহাড়ে এমন স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী।
সেনাবাহিনী কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা মহামারীর এই সংকটকালীন সময়ে সাধারণ মানুষ নিজেদের করোনা মুক্ত তথা সংক্রমণ মুক্ত রাখতেই ব্যতিব্যস্ত। এমতাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকাগুলোতে মানবিক ত্রাণ সহায়তা করতে গিয়ে তারা পাহাড়ী এলাকায় গর্ভবতী মায়েদের সুচিকিৎসা ও পুষ্টিকর খাবারের অভাবের বিষয়টি স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন। এছাড়া সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগের নানা সীমাবদ্ধতার ফলে দূর্গম পল্লীতে এসব গর্ভবতী মায়েরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া করোনাকালীন সময়ে অন্যান্য রোগীরা নানাভাবে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করলেও গর্ভবতী ও সন্তান সম্ভবা এসব মায়েরা এসময়ে সব ধরণের স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত। তাই পাহাড়ের এসব গর্ভবতী মায়েদের গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় সুচিকিৎসা ও পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, পাশাপাশি অসহায় ও কর্মহীন হয়ে পড়া পরিবারগুলোর মাঝে খাদ্য সহায়তাও পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। করোনা সংকটকালীন সময়ে পাহাড়ে ধারাবাহিকভাবে এসব চিকিৎসা সেবা ক্যাম্প চলমান থাকবে বলেও জানান সেনা কর্মকর্তারা।
অতীতের পার্বত্য চট্টগ্রামে মহামারী কলেরা, ম্যালেরিয়া, দূর্ভিক্ষসহ নানা দূর্যোগে পাহাড়বাসীর বিপদে-আপদে পাশে থেকে এমনকি নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে পাহাড়বাসীদের জীবন বাঁচিয়ে নেয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়টাতে এমন মানবিক কর্মকান্ডে খুঁশি পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী।
