সেনাবাহিনীর হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, তৈরী হচ্ছে সামরিক পরিবহণ - Southeast Asia Journal

সেনাবাহিনীর হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, তৈরী হচ্ছে সামরিক পরিবহণ

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা অটোমোবাইলস খাতটি অন্যান্য শিল্পের মত বিকাশিত না হলেও এই শিল্পে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে। অটোমোবাইল খাতের সরকারি যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম সর্বাধিক শোনা যায় তার মধ্যে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি অন্যতম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অধিনস্ত বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (BMTF) সামরিক পরিবহণ যান নির্মাণকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরী করা হলেও এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে সামরিক যান এর পাশাপাশি বেসামরিক বিভিন্ন যানবাহন এবং বিভিন্ন বানিজ্যিক পন্য উৎপাদনে যুক্ত রয়েছে।

১৯৭৯ সালে ১১ই ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটি বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো এবং আধুনিক সুবিধাযুক্ত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর একটি গাড়ি নির্মান প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সামরিক এবং আধা-সামরিক বাহিনীগুলোর গাড়ি মেরামতের চাহিদা বিবেচনায় প্রতিষ্ঠা করা এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে গাড়ি মেরামতের পাশাপাশি বিভিন্ন গাড়ি নির্মাণ এবং সংযোজন করে আসছে।

১৯৯৬ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র গাড়ি মেরামত এবং সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ছোট সরঞ্জাম তৈরীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ২০০০ সালে এসে এই প্রতিষ্ঠান এর অধীনে প্রথমবারের মত যুক্ত হয় ভেহিক্যাল এসেম্বলি শপ, যেখানে ২০০১ সাল থেকে ইসুজুর তৈরী ৩ টনের ট্রাক এসেম্বল করার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানটি তার নতুন গাড়ি শিল্পের বিকাশ শুরু করে। প্রথম দিকে শুধুমাত্র ইসুজু ট্রাকের সকল সরঞ্জাম আমদানি করে এসেম্বেল করা হলেও পরবর্তীতে এই প্রতিষ্ঠান টি নিজেই এই ট্রাকের চেসিস, বডি, টায়ার, ব্রেকিং সিস্টেম সহ বিভিন্ন যন্ত্রংশ নিজেরাই উৎপাদন শুরু করে। তার কিছু সময় পর এই প্রতিষ্ঠানটি এই ট্রাকের ইঞ্জিন বিভিন্ন অংশ উৎপাদনে যায়, যার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে এই ট্রাকের ৭০% যন্ত্রপাতি এখন দেশেই তৈরী হচ্ছে। শুধু ইসুজু -৩ টন ট্রাক নয়, একই সময়ে জাপানের আরেক গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টয়োটার সাথে BMTF চুক্তিবদ্ধ হয়ে টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার ইউটিলিটি জীপ এবং ইউটিলিটি ট্রাক উৎপাদন শুরু করেছে। একই সময়ে এসে BMTF ব্রিটিশ বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মান সংস্থা Land Rover কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং তাদের উৎপাদিত ল্যান্ড রোভার ডিফেন্ডার ইউটিলিটি ভেহিক্যাল এর এসেম্বলি লাইন চালু করে। সেই সাথে এই দুই কোম্পানির বিভিন্ন পার্টস উৎপাদন এবং সরবরাহের দায়িত্ব পায়। বর্তমানে টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার এর ইঞ্জিন এর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ সহ অন্যান্য সকল সরঞ্জাম বি এম টি এফ নিজেই উৎপাদন করছে।

বাংলাদেশের অটোমোবাইলস শিল্পের অন্যতম অগ্রদূত হিসাবে বি এম টি এফ এর অধীনে বর্তমানে ১১ টি বিভিন্ন ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে,

১) মেশিন শপ: যা মুলত সামরিক বেসামরিক বিভিন্ন যানবাহন এর যন্ত্রংশসহ মুল যন্ত্র তৈরী করে থাকে। এই ইউনিট গাড়ির ইঞ্জিন তৈরী এবং মেরামতের মুল কাজ সম্পন্ন করে।

২) স্টীল কাটিং শপ: যেখানে গাড়ির বডি আর্মর পেল্ট, রোলেড স্টীল বডি, চেসিসসহ বিভিন্ন ভারী যন্ত্রপাতি তৈরী হচ্ছে৷

৩) ভেহিক্যাল এসেম্বলি শপ: যা বি এম টি এফ এর মুল কারিগরি ইউনিট। এই ইউনিটে বর্তমানে বিভিন্ন যানবাহন উৎপাদন করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে বি এম টি এফ বিশ্বে ৮ টি বৃহৎ গাড়ি নির্মান প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যৌথ ভাবে এখানে গাড়ি নির্মান এবং সংযোজন করে আসছে। যার মধ্যে রয়েছে,

> অরুনিমা- ৩ টন মিডিয়াম ট্রাক (জাপানের ইসুজু কোম্পানি থেকে প্রযুক্তি নিয়ে বানানো) – [ব্যবহারকারী – সামরিক বাহিনী]

>টয়োটা- ৬৯, ১.৫ টন পিকআপ এবং টয়োটা ৭০, ১- টন ল্যান্ড ক্রুজার ইউটিলিটি ভেহিক্যাল। [ব্যবহারকারী -সামরিক বাহিনী]

> নিশান ইউটি– ৩২ সিট ক্র ট্রান্সপোর্ট এসি বাস। (জাপানি প্রযুক্তি সহায়তায় এসেম্বল)- [সামরিক, বেসামরিক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান এর জন্য সরবরাহকৃত]

> ডেও এক্সপ্রেস- ৫২সিট ট্রুপস পরিবহন বাস (দক্ষিন কোরিয়ান) [সামরিক, বেসামরিক এবং সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর জন্য সরবরাহকৃত]

>মিটসুবিসি রোসা- ৩২/৪০ সিট ট্রুপস ট্রান্সপোর্ট বাস/ প্রিজন ভ্যান (জাপান ) [ সামরিক বাহিনী এবং পুলিশের জন্য]

>মিটসুবিসি ৩ টন পিকআপ পুলিশ ভ্যান (জাপান)- [পুলিশ এবং অন্যান্য আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ]

> অশোক লি-ল্যান্ড- ৭ টন মিডিয়াম ট্রাক ( ভারত)- [ব্যবহারকারী -বি টি আর সি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ]

> জে.এম.সি- ১.৫ টন এবং ৩.৫ টন পিকআপ ট্রাক (চীন)- [বানিজ্যিক উদ্দেশ্য সংযোজন এবং সরবরাহকৃত]

> সাইনো ৩ টন এবং ৫ টিন ট্রাক (চীন) – [বানিজ্যিক উদ্দেশ্য সংযোজন এবং সরবরাহ ]

৪) বর্তমানে বিএমটিএফ ভেহিক্যাল এসেম্বল প্লান্ট এর অধীনে বছরে ৫০০০ মোটরসাইকেল এবং ৩৫০০ বিভিন্ন যান সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে। এর বাইরে বি এম টি এফ এর অধীনে রয়েছে
ভারি কারখানা ইউনিট, যেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা ট্যাংক, এপিসি, বিভিন্ন কামান এর মেরামত করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বহরে থাকা টাইপ-৫৯ এবং টাইপ-৬৯ ট্যাংক এই ইউনিট এর অধীনে উন্নত করা হয়েছে। এছাড়া এই ইউনিটে সেনাবাহিনীর বিটিয়ার-৮০ এপিসি সমুহের মেরামত করা হয়ে থাকে।

৫) তাপ এবং চাপ পরীক্ষা কেন্দ্র: এটি হলো এই প্রতিষ্ঠান এর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেখানে বিভিন্ন যানবাহন এর জন্য ব্যবহার করা স্টীল এবং বডি স্ট্রাকচারের উপর উচ্চ চাপ এবং তাপ এর মাধ্যমে তাদের সহন ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়।

৬) বিএমটিএফ এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট হচ্ছে এর লেদার ফ্যাক্টরি: যেটি মুলত বাংলাদেশ সকল বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় জুতা চামড়াজাত বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম, গাড়ির অভ্যন্তরীণ সাজ সজ্জার কাজ করে থাকে। এই ইউনিট এর উৎপাদিত পন্য দেশের বাইরেও রপ্তানি হয়ে থাকে।

৭) ইলেকট্রনিক শপ: সামরিক পরিবহন নির্মাণের উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরী করা এই প্রতিষ্ঠান টি পরিবহন সরঞ্জাম এর পাশাপাশি ইলেকট্রনিকস পন্য উৎপাদনের সাথে কয়েক দশক ধরে যুক্ত রয়েছে৷ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পন্য উৎপাদনের পাশাপাশি দেশে বিদ্যুৎ এর ট্রান্সমিটার এর চাহিদা পূরন করে আসছে বি এম টি এফ।

এর বাইরে এই প্রতিষ্ঠান বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে নিয়ে বিভিন্ন প্লান্ট স্থাপন করেছে যার অধীনে রয়েছে,

৮) বিএমটিএফ ফার্নিচার ফ্যাক্টরি: বিএমটিএফ এর নতুন সংযোজিত এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়৷ এই ইউনিট এর কাজ অধীনে সেনাবাহিনীর অধীনে পরিচালিত এই সংস্থা টি সামরিক, বেসামরিক, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর জন্য আসবাবপত্র ডিজাইন এবং উৎপাদন করে আসছে। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠান বাইরে রপ্তানির উদ্দেশ্যে কাজ করছে।

৯) পোল ফ্যাক্টরি: সামরিক সরঞ্জাম এর পাশাপাশি বিভিন্ন স্থাপনা এবং স্টাইল ব্রিজ নির্মানের জন্য বিএমটিএফ এর অধীনে রয়েছে পোল ফ্যাক্টরি যা স্টীল ব্রিজ নির্মাণে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন স্প্যান, স্টীল স্ট্রাকচার বেয়ারিং নির্মাণ করে থাকে।

১০) বিএমটিএফ সিএফএল/এলইডি ব্লাভ ফ্যাক্টরি: বিএমটিএফ এর আরেকটি বেসামরিক পন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যা ২০১৩ সাল থেকে দেশে বিভিন্ন প্রকার সিএফএল এবং এলইডি বাতি প্রস্তুত করে আসছে।

এছাড়া বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরী করছে। বাংলাদেশ অটোমোবাইল শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু সামরিক বাহিনীর নয় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়ে অবদান রেখে চলছে। অদূর ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য বিভিন্ন সামরিক যুদ্ধ যান তৈরীর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে।