পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঁশের চারা প্রকল্প, অস্তিত্ব না থাকলেও খাতা-কলমে গতি

নিউজ ডেস্ক
পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৬ উপজেলায় কৃষকদের সাবলম্বী করতে উন্নত জাতের বাঁশের চারার প্রজেক্টটি খাতা কলমে বাস্তবায়নের গতি থাকলেও প্রকল্পের অস্তিত্ব নেই অধিকাংশ এলাকায়। ২৫ কোটি টাকা ব্যায়ে ৫ বছর মেয়াদি প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৬ সালে। বিগত ৪ বছরেও প্রকল্প কর্মকর্তা-কর্মচারীর দেখা পাননি স্থানীয় প্রতিনিধি এবং পাহাড়ী এলাকার বাসিন্দারা। অভিযোগ রয়েছে, পাহাড়ের বুনো বাঁশের বাগানকে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত দেখিয়ে লুটে নেয়া হচ্ছে পুরো টাকা। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে রাজি হননি। তবে বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যানের দাবী দৃশ্যমান হতে সময় লাগবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নিয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য মতে. দূর্গম পাহাড়ে বসবাসরত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় আনতে উন্নতমানের বাঁশ চাষ নামের একটি প্রকল্প চলছে তিন পার্বত্য জেলায়। এই প্রকল্পের আওতায় প্রতি এক একর জমি আয়তনের ১৩ হাজার আলাদা বাগান গড়ে তুলবে প্রকল্প প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি বাগানের মালিক হবে একটি করে কৃষক পরিবার। এ হিসেবে অন্তত ১৩ হাজার পরিবার এ প্রকল্পের সুবিধাভোগী হবেন। একই সাথে স্থানীয়ভাবে উদ্যেক্তা তৈরী করে ২৬০টি বাঁশ নির্ভর ক্ষুদ্র কুটির শিল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারিত আছে প্রকল্পটিতে। প্রকল্পের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৩ হাজার নতুন বাঁশ বাগানের পাশাপাশি উপকার ভোগীদের মাঝে ২৮ লাখ ৬০ হাজারটি বরাক, বারি, মিতিঙ্গা, মুলি, ডলু, ওরা জাতের বাঁশের চারা বিতরণের কথা ছিলো। ৫ বছর প্রকল্পর ৪ বছর পেরিয়ে গেছে গত ৩মাস আগে, কিন্তু এখনো দৃশ্যমান কিছু্ই হয়নি কোথাও।
প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রকল্পটি গ্রহনের প্রেক্ষাপট হিসেবে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে অনগ্রসর ও দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে আলাদা একটি অঞ্চল। দেশের মোট আয়তনের দশ শতাংশ এলাকা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং এর ৯০% শতাংশ এলাকা হচ্ছে পাহাড় ও বনাঞ্চল দ্বারা পরিবেষ্টিত। অত্র এলাকা জনগন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এলাকায় বেষ্টিত বনাঞ্চলের বাঁশ ও কাঠের উপর নির্ভরশীল। পাবর্ত্য এলাকার কাচালং, রাইখ্যং, সাংগু ও মাতামুহুরী ইত্যাদি নদীবিস্তৃত এলাকায় অধিকাংশ বাঁশ উৎপাদন হয়। এই এলাকায় মুলি বাঁশের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। তবে ভূমি দখল, নির্বিচারে বন উজাড়, ভূমির ব্যবহারের ধরণ পরিবর্তন, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভূমি ব্যবস্থাপনা, প্রতি বছর স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে চাষ পদ্ধতির ফলে বন উজাড় এইসব কারণে প্রতি বছর ২.৬ শতাংশ হারে বাঁশ উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এছাড়াও ২০০৬ সাল থেকে সাম্প্রতিককালের বাঁশের ফুল হওয়ার কারণে বাঁশের উৎপাদন অনেক কমে যাচ্ছে। স্বাধীনতার প্রায় দুই দশকের উর্ধ্ব সময় ধরে অত্রাঞ্চলে যে অস্থির পরিবেশ ছিল তা ১৯৯৭ইং সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে অবসান হয়। অত্রাঞ্চলে বিভিন্ন সংঘাটের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে এবং অত্রাঞ্চলের জনগণ উন্নয়নের জন্য যে পিছিয়ে ছিল তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য পার্বত্য চু্ক্তি পরবর্তী সময়ে আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কল্যানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। যেহেতু অত্রাঞ্চল পূর্ব থেকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে পিছিয়ে পড়া একটি অঞ্চল তাই এই এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগণের প্রতি বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প ও কার্যক্রম গ্রহন করার লক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কাজ করে যাচ্ছে এবং “পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনগ্রসর জনগোষ্ঠির আয় বর্ধনমূলক কর্মসূচি হিসাবে উন্নত জাতের বাঁশ উৎপাদন” শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবনা গ্রহন করেছে।
প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য একটি এলাকা রাঙামাটির কাউখালি উপজেলা। এখানে বেশ কিছু বড় বড় বাঁশ বাগানের দেখা মেলে,কিন্তু বাগানের মালিকরা জানান বংশ পরম্পরায় এসব বাগানের মালিক হয়েছেন তারা। এর সঙ্গে কোন প্রকল্পের সম্পর্ক নেই। এছাড়া উন্নয়ন বোর্ডে কোন কর্মকর্তাকেও তারা কখনো দেখেন নি এলাকায়।
স্থানীয়রা বলছেন, এসব এলাকায় নিজে নিজেই বাঁশ বাগান গড়ে উঠে, কোন প্রকল্প নয় এগুলো। আবার কেউ কেউ বলছেন, তারা নিজেরাই তাদের জমিতে ব্যক্তি উদ্যোগে বাঁশ বাগান গড়ে তুলেছেন, সরকারী কোন সহায়তায় নয়।
কাউখালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা চৌধুরী জানান, ৪বছর ধরে তার উপজেলায় বাঁশের এই প্রকল্প চলছে এটা তিনি এই প্রথম সাংবাদিকদের কাছেই শুনেছেন। এমনকি তার অফিসের কোন কর্মকর্তা বা ইউপি চেয়ারম্যানরাও এমন প্রকল্পের বিষয়ে কিছুই জানে না।
এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বক্তব্য জানতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে গেলে প্রকল্প পরিচালক হারুন উর রশিদকে তার কার্যালয়ে পাওয়া যায় নি। এছাড়া মুঠোফোনে বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় গণমাধ্যম কর্মীরা। তবে সদ্য যোগদান করা বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল আলম নিজামী জানান, প্রকল্প পরিচালক তাকে জানিয়েছেন লাগানো বাঁশের চারাগুলো এখনো বড় হয়নি, তাই আরো কিছুদিন না গেলে তা দৃশ্যমান হবেনা। তিনি জানান, প্রকল্পটি তো মাত্র শুরু হলো, তা দৃর্শ্যমান হতে সময় লাগবে আরো। তিনি দাবী করেন কাজ না করে বা প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে কোন ধরনের উল্টাপাল্টা কাজ হয়না।
সংশ্লিষ্টরা জানান তিন পার্বত্য জেলার অধিকাংশ এলাকাই পাহাড় ও বনাঞ্চল দ্বারা বেষ্টিত। এখানকার কাচালং, রাইখং, সাঙ্গু, মাতামুহুরি নদীসহ পাহাড়ী নদীগুলোর চারপাশে প্রচুর বাঁশের উৎপাদন হয় আবহমানকাল ধরে। প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে উঠা এসব বাঁশ বাগানকে প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত করে লুটে নেয়া হয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা।