পাহাড়ে দাতা সংস্থার তৎপরতা পৃথক রাষ্ট্র গঠনের গভীর ষড়যন্ত্র নয় তো?

পাহাড়ে দাতা সংস্থার তৎপরতা পৃথক রাষ্ট্র গঠনের গভীর ষড়যন্ত্র নয় তো?

পাহাড়ে দাতা সংস্থার তৎপরতা পৃথক রাষ্ট্র গঠনের গভীর ষড়যন্ত্র নয় তো?
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

ড. এম আব্দুল মোমিন

পার্বত্য চট্টগ্রামে এনজিওদের তৎপরতা দিনে দিনে বাড়ছে। এসব তৎপরতা ঘিরে জনমনে ক্রমশ গভীর সন্দেহ ও শঙ্কা জন্ম নিচ্ছে যে হয়তো এর পেছনে কোনো গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। উন্নয়নের নামে পরিচালিত এ সংগঠনগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বহুবার, কিন্তু এখন তা আরও ঘনীভূত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় পরিচালিত অসংখ্য এনজিও পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, মানবাধিকার, খাদ্য নিরাপত্তা, সংস্কৃতি সংরক্ষণসহ নানামুখী কর্মসূচি চালালেও এইসব কার্যক্রমে পক্ষপাতিত্ব স্পষ্টভাবে এই সন্দেহ ও শঙ্কাকে উসকে দিচ্ছে। বিশেষ করে উপজাতি জনগোষ্ঠির প্রতি এনজিওগুলোর অতিরিক্ত মনোযোগ এবং বাঙালি জনগোষ্ঠিকে পরিকল্পিতভাবে উপেক্ষা করার প্রবণতা সমাজে এক প্রকার বৈষম্য ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

বিভিন্ন এনজিও পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রসারের নামে আলাদা জাতিসত্তা ও ভাষার ভিত্তিতে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে উৎসাহিত করছে, যা ভবিষ্যতে একটি ভিন্ন রাষ্ট্রের দাবি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ভিত্তি হতে পারে বলে সন্দেহ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ান দাতা সংস্থাগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রকল্প ও কর্মসূচির মাধ্যমে সক্রিয় রয়েছে। মোটা দাগে বলা হয়, এই সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হিসেবে মানবিক সহায়তা, দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ। কিন্তু বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন।

প্রকৃতপক্ষে এসব সংস্থা তাদের তহবিল, কারিগরি সহায়তা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি গোষ্ঠিকে নানা সুবিধা প্রদান করে যাচ্ছে এবং দীর্ঘ মেয়াদে একটি বিচ্ছিন্ন ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের ভিত্তিতে ভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পায়তারা গড়ে তোলার পরোক্ষ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দাতা সংস্থাগুলো ইউএনডিপির ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন সহায়তা প্রকল্প (CHTDF)’ এর মাধ্যমে উপজাতি জনগোষ্ঠিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক সহায়তা, স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের নামে একচেটিয়া সুবিধা দিয়ে আসছে যেখানে বাঙালি জনগোষ্ঠিকে কার্যত বঞ্চিত রাখা হয়েছে। তাদের শিক্ষা প্রকল্প, স্কুল, কলেজ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে উপজাতিদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়, এমনকি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উপজাতীয় ভাষা ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে যা একটি বৈষম্যমূলক ও বিভাজনমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে।

ইউএনডিপি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইডেন, নরওয়ে, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনেক এনজিও ও দাতা সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করছে, যারা সাধারণত ‘সুশাসন’, ‘আদিবাসী অধিকার’ এবং ‘নিরাপদ বসবাস’ ইত্যাদি শ্লোগান সামনে রেখে কাজ করলেও তাদের প্রকৃত এজেন্ডা নিয়ে জনমনে এখন প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, এই সংস্থাগুলো কৌশলে উপজাতি নেতৃত্বাধীন সুশাসন কাঠামোকে শক্তিশালী করছে, স্বায়ত্তশাসন ও প্রশাসনিক স্বাধীনতার নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি পৃথক ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করছে।

স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত এনজিওগুলোর অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে উপজাতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে নিকট সম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করছে এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার অর্থ এইসব বাহিনীর প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার হচ্ছে বলেও শোনা যাচ্ছে। এনজিওগুলোর প্রশিক্ষণ, সভা, কর্মশালা, গবেষণা ও প্রকাশনায় বারবার ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে ‘উপজাতি জাতিসত্তার স্বীকৃতি’ দাবি তাদের কার্যকলাপের উদ্দেশ্য নিয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।

অনেক ক্ষেত্রেই এই সংস্থাগুলো সরকারি প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই এলাকায় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে এবং তাদের তদারকি কার্যক্রম সীমিত হওয়ায় তারা কার্যত নিজেদের মতো করেই এক ধরনের সমান্তরাল শক্তি হিসেবে গড়ে উঠছে। শুধু উপজাতিদের জন্য পরিকল্পিত স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা কর্মসূচি, নারীদের জন্য বিকল্প জীবিকা সহায়তা প্রকল্প—সবই একচেটিয়া সুবিধা দিচ্ছে নির্দিষ্ট গোষ্ঠিকে, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠি চরমভাবে অবহেলিত। এতে সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে এবং দীর্ঘমেয়াদে সংঘাতের ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে।

বিভিন্ন সময়ে তথ্যপ্রমাণসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, এনজিওগুলোর একটি অংশ বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সাথেও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক গুরুত্ব, জাতিগত বৈচিত্র্য ও জাতিসত্তার টানাপোড়েনকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অখণ্ডতা চ্যালেঞ্জ করতে চায়। এমনকি জাতিসংঘে উপজাতিদের হয়ে গোপনে প্রতিনিধিত্ব করার প্রক্রিয়াও একাধিকবার ধরা পড়েছে। ফলে এই এনজিওগুলোর কার্যক্রম শুধু উন্নয়নমূলক নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে একটি ভিন্ন রাষ্ট্র গঠনের গ্রাউন্ডওয়ার্ক হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এনজিওগুলোর কার্যক্রম কঠোর নজরদারির আওতায় আনা, তহবিলের উৎস ও ব্যয় খতিয়ে দেখা, এবং উপজাতি-বাঙালি উভয় গোষ্ঠির প্রতি সমান সুযোগ ও উন্নয়ন নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র যদি এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নেয়, তবে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলটি একটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে রূপ নিতে পারে, যার মূল পরিকল্পনা অনেক আগেই শুরু করে দিয়েছে কিছু বিদেশি শক্তি এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত এনজিওরা। জনমনে প্রশ্ন, তারা কি উন্নয়ন করছে, না কি একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পিত ভিত্তি তৈরি করছে—এর জবাব এখন রাষ্ট্রকেই খুঁজে বের করতে হবে। এবং এদের গোপন মিশন সম্পর্কে তথ্য উদঘাটন করতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতে উপজাতিদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল, ক্লিনিক, মোবাইল মেডিকেল টিম, জন্ম ও শিশু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কর্মসূচির বিস্তৃতি থাকলেও পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালি জনগণ এসব সেবার বাইরে রয়ে গেছে। স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে উপজাতিদের জন্য আলাদা প্রশাসনিক শক্তি গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে বাঙালিদের অংশগ্রহণ এবং সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। ইউএনডিপি এবং দাতা সংস্থাগুলো রাজনৈতিকভাবে এই কাঠামোকে সমর্থন ও শক্তিশালী করে তুলছে এবং বিভিন্ন সময়ে উপজাতি সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সাথে পরোক্ষ সমন্বয় সাধন করে থাকে যা একটি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক সংকেত।

দাতা সংস্থাগুলোর তহবিলের একটি বড় অংশ উপজাতি-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ব্যয় হয়, সেখানে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে তেমন কোনো প্রকল্প চোখে পড়ে না। উপজাতিদের সংস্কৃতি, ভাষা ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার নামে প্রকল্পভিত্তিক প্রচারণা, গবেষণা ও কর্মশালা আয়োজন করে দাতা সংস্থাগুলো একটি আদিবাসী জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে উস্কে দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের কৌশলগত ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক দাতা সংস্থা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এনজিওগুলোর মাধ্যমে পাহাড়ে এমন সব কার্যক্রম পরিচালনা করছে যা প্রথাগত বাঙালি সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় ঐক্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করছে। তারা বারবার উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ বলে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মাধ্যমে পার্বত্য ইস্যুতে বাংলাদেশকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চায় এবং জাতিসংঘে উপজাতিদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি করছে।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

বাঙালি জনগণ এসব সংস্থার পক্ষপাতদুষ্ট কাজের ফলে পাহাড়ে তাদের জমি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চাকরি, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বাঙালিদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। এর ফলে পাহাড়ে এক ধরণের বঞ্চনা ও হতাশা তৈরি হয়েছে যা সামাজিক অস্থিরতারও জন্ম দিচ্ছে। ইউএনডিপি ও দাতা সংস্থাগুলোর পক্ষপাতমূলক প্রকল্প, অর্থায়ন ও কার্যক্রমে একটি লক্ষ্য সুস্পষ্ট—তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘমেয়াদে পৃথক একটি রাষ্ট্র গঠনের মানসিকতা ও অবকাঠামো তৈরি করা। এরা সরাসরি অস্ত্র তুলে না দিলেও উপসর্গগুলো এমনভাবে তৈরি করছে যা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সহায়তায় আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দিতে পারে।

তাই পাহাড়ের জনগণের মধ্যে বিভেদ তৈরি ও রাষ্ট্রের অখণ্ডতা নষ্ট করার এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। এসব দাতা সংস্থা ও এনজিওর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং যেখানে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য হচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সকল জাতিগোষ্ঠিকে সমান সুযোগ, উন্নয়ন ও সহায়তা প্রদান করতে হবে, যাতে কোনো গোষ্ঠিই নিজেদের অবহেলিত না মনে করে এবং কেউ যেন বিদেশি সহায়তায় বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত হতে না পারে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় এই বিদেশি হস্তক্ষেপ ও পরিকল্পিত দানশীলতা থেকে সাবধান থাকা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *