ভোটার হয়ে পাহাড়ে বসতি গড়ে তুলছে রোহিঙ্গারা
নিউজ ডেস্ক
২০১৭ সালের আগষ্টে আরাকানে একটি নিরাপত্তাচৌকিতে হামলার জের ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ও এর আগেও বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা এবার জালিয়াতি করে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব সনদ তৈরী করে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
মিয়ানমার থেকে এদেশে আসার ৫ বছরের মধ্যেই একটি রোহিঙ্গা পরিবারের চার ছেলে, এক মেয়ে সবাই বাংলাদেশের ভোটার হয়েছেন এবং পাহাড়ের নির্জন একটি এলাকায় দোতলা বাড়ি করছেন। রোহিঙ্গা পরিবারটির প্রধান আমির আলী জানান, তিনি তার স্ত্রী আমিনা খাতুন ও তাদের পাঁচ সন্তান প্রায় পাঁচ বছর আগে মিয়ানমারের মংডু থেকে বাংলাদেশে আসেন। তারা এখন বান্দরবানের কাইছতলীতে বসতি স্থাপন করেছেন। তিনি জানান, প্রায় দশ শতক জায়গার ওপর পরিবার নিয়ে তিনি আছেন এবং সেই জায়গাটি তিনি কারও কাছ থেকে ক্রয়ও করেন নি। ২০১৭ সালের আগে সীমান্ত অতিক্রম করে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে বসবাস শুরু করেছেন, আমির তাদেরই একজন এবং এটি তিনি অবলীলায় স্বীকার করেছেন।
বান্দরবানের স্থানীয় বাসিন্দা ও বাংলাদেশী নাগরিক মোঃ সিরাজ মিয়া জানান, শুধু আমিরের পরিবার নয়, হলুদিয়া থেকে প্রান্তিক লেক পর্যন্ত এখন প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা পরিবার রয়েছে। প্রতিনিয়ত এখানে নতুন নতুন রোহিঙ্গাদের দেখা যাচ্ছে।
তবে সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গারা জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় রোহিঙ্গারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করছেন এবং সেখানকার ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারছেন। এছাড়া রোহিঙ্গা পরিবারগুলো বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির অধীনে বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, ভিজিডি- ভিজিএফসহ নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সরকারি ভাতা পান বলেও জানান তিনি।
মিয়ানমারের বুচিডং এলাকা থেকে আসা ও বর্তমানে বান্দরবানের সুয়ালক ইউনিয়নের হরিণ মারা এলাকায় বসতি স্থাপন করে পরিবার নিয়ে বসবাস করা নূর নাহার বলেন, ‘আমরা একজন স্থানীয়কে বছরে চার হাজার টাকার দিয়ে এই এলাকায় বসবাস করি।’ ‘হরিণ মারা এলাকায় ২২টি রোহিঙ্গা পরিবার ইতোমধ্যে বসতি স্থাপন করেছেন। তাদের অনেকেই বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রও সংগ্রহ করেছেন। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা নেই বলে আমার স্বামী ও আমি এখনো কার্ডটি পাইনি’, বলেন নূর নাহার।
এই এলাকার জাফর আলম নামে একজনের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে যেটি ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর বান্দরবান থেকে ইস্যু করা হয়েছিল। জাতীয় পরিচয়পত্রে জাফরের জন্মস্থান কক্সবাজার দেখানো হয়েছে এবং তার জন্ম সাল দেখানো হয়েছে ১৯৬৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। জাফরের প্রতিবেশী ফাতেমা বেগম বলেন, ‘জাফর বেশ কয়েক বছর আগে মিয়ানমার থেকে এসে এই এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।’ জাফর এখন সেটি অস্বীকার করে বলছেন, তার জন্ম বাংলাদেশের কক্সবাজারে। বান্দরবানে এসে তিনি ভোটার হয়েছেন।
নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাবিবুল্লাহ বলেছেন, ‘দোছড়িতে প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গা আছেন, যারা কয়েক বছর আগে এখানে এসেছেন।’ তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দোছড়ি এলাকার কয়েকজন স্থানীয় দাবি করেছেন যে, চেয়ারম্যান হাবিবুল্লাহর বাবা-মাও মিয়ানমার থেকে আসা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘আমার বাবা-মা বহু বছর আগে কক্সবাজারের রামু এলাকায় থাকতেন। তবে, আমার জন্ম দোছড়িতে।’
জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় অনেকেই জানায়, প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা পরিবার বান্দরবান জেলায় বসতি স্থাপন করেছেন। এদের বেশিরভাগ নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলীকদম, রোয়াংছড়ি ও বান্দরবান সদরে রয়েছেন। আলীকদম উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন বলেন, ‘গত সাত-আট বছরে প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গা পরিবার উপজেলায় বসতি স্থাপন করেছে এবং এখানে বার্মাইয়া বা বার্মিজ পাড়া নামে একটি গ্রামও রয়েছে।’ সুয়ালক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উ ক্যনু মারমা বলেন, ‘২০০৭-২০০৮ সালের আগে সুয়ালক এলাকায় রোহিঙ্গা ছিল না। কিন্তু, এখন এই এলাকায় প্রায় দুই শর বেশি রোহিঙ্গা পরিবার বাস করে।’ তিনি আরও জানান, এর মধ্যে এই এলাকার প্রায় ৫০টি রোহিঙ্গা পরিবার ভোটার তালিকায় নিবন্ধিতও হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের বান্দরবান চ্যাপ্টারের সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় প্রশাসন কেবল রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপন করতে সহায়তা করছে না, তারা তাদেরকে ভোটার তালিকায়ও অন্তর্ভুক্ত করছে।