মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডাঃ মাহফুজুর রহমানের বক্তব্যে কি বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে?

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

ইমতিয়াজ আহমেদ

সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে পার্বত্য জেলা পরিষদ অনুমোদিত জমিতে পর্যটনবান্ধব কিছু উদ্যোগ গ্রহন করার বিরুদ্ধে যে সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, সেই সূত্র ধরে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষনা কেন্দ্র ট্রাস্ট — চট্টগ্রাম এর চেয়ারম্যান ডাঃ মাহফুজুর রহমানের একটি মন্তব্য দেশবাসীর কাছে বিভ্রান্তিকর বার্তা নিয়ে আসতে পারে মনে করে আমার এই লেখার অবতারণা। ডাঃ মাহফুজুর রহমানের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গ্রহনযোগ্য ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয়, এই বক্তব্যের সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ! বৃটিশ আমলে সৃষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি সার্কেলের মধ্যে বান্দরবানের বোমাং সার্কেল এবং রাঙ্গামাটির চাকমা সার্কেল প্রধানগণ মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধীতা করেছিলেন। শুধুমাত্র খাগড়াছড়ির মং সার্কেল প্রধান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে থাকায় এই সার্কেলে বসবাসরত গুটি কয়েক ব্যক্তিবর্গ এবং রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার দুই একজন বিচ্ছিন্ন ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার তথ্য গ্রহনযোগ্য সূত্রে পাওয়া যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জনগোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মতামত কিরূপ ছিল, সেই সম্পর্কে বিতর্ক থাকতে পারে; কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় বসবাসকারী সবাই জানেন সার্কেল চীফদের মতামতের বাইরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করাটা তাদের জন্য সহজ ছিল না। রাঙ্গামাটির চাকমা সার্কেল প্রধান এবং বান্দরবানের বোমাং সার্কেল প্রধান শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেই ক্ষান্ত থাকেননি, তাদের অপতৎপরতায় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা পার্বত্য চট্টগ্রামে শহীদ হয়েছেন। চাকমা সার্কেল প্রধান ত্রিদিব রায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সরাসরি সহযোগিতার পাশাপাশি পাকিস্তানের মদদপুষ্ট মিজো বাহিনীকেও ব্যপকভাবে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় চাকমা জনগোষ্ঠী এবং মিজো বাহিনীই মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সফল অপতৎপরতা দেখিয়েছিল। কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন দূর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার মাঝে সফল হওয়া সম্ভব ছিল না। মহালছড়িতে ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার ঘটনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাশাপাশি মিজো বাহিনীর সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। ডাঃ মাহফুজুর রহমান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ ভাবে গবেষনা করে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বোমাং সার্কেল ও চাকমা সার্কেল প্রধানদের অপতৎপরতা সম্পর্কে সহজেই অবগত হওয়ার কথা ছিল।

স্বাধীনতার পর সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে উপজাতি নেতৃবৃন্দের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবী এবং পরবর্তীতে শান্তিবাহিনী গঠন করে যে সশস্ত্র অপতৎপরতা তারা দেখিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী যে কারও কাছেই বিষয়টি মেনে নেওয়া কষ্টকর। মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ডাঃ মাহফুজুর রহমানের নিশ্চয়ই এই বিষয়টি দৃষ্টি এড়ায়নি।

ডাঃ মাহফুজুর রহমান ব্যক্তিগত ভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন অনুগত ও অনুরক্ত ব্যক্তিত্বরূপে পরিচিত। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ ও লালন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের উপর ভিত্তি করেই দেশের জনগন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত হয়েছিল। ডাঃ মাহফুজুর রহমান ব্যক্তিগতভাবে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক একজন চিকিৎসক হলেও উনার জীবনের বড় একটি অংশ কাটিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষনা করে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য অনেকগুলো গবেষনাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার মধ্যে “বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ”, “বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ — নিউক্লিয়াস” এবং “ধানমন্ডি থেকে বাংলাদেশ” অন্যতম। তার গবেষনা প্রতিষ্ঠান “বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষনা কেন্দ্র ট্রাস্ট — চট্টগ্রাম” সরকার থেকে কোন প্রকার অনুদান গ্রহনে উৎসাহী নয় এবং ডাঃ মাহফুজুর রহমান মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের তালিকা সঠিক নয়। এই ধরনের একজন ব্যক্তিত্বের কাছে সঠিক বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্য নির্ভর বক্তব্যই জাতি আশা করে। ডাঃ মাহফুজুর রহমান নিশ্চয়ই অবগত আছেন, যে বঙ্গবন্ধুকে তিনি তার জীবনে পরম শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন, সেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি নেতৃবৃন্দের কোন তৎপরতা তার চোখে পড়েছে কি?

ডাঃ মাহফুজুর রহমান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে গবেষনার বিষয়ে তার একাগ্রতার কারনে বর্তমানে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় তিনি মোটামুটি ভাবে প্রচারিত হন। জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে কোন স্বার্থান্বেষী মহল তার গ্রহনযোগ্যতাকে অপব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে লালিত আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করছে কি না, বিষয়টিও ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। আশা করি মুক্তিযুদ্ধের একজন একনিষ্ঠ গবেষক হিসাবে ডাঃ মাহফুজুর রহমান তার বক্তব্যের ত্রুটি সংশোধনী প্রকাশ করবেন এবং নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে অনুপ্রানীত করবেন।

 

সূত্র
১। পেপার কাটিং।
২। https://www.youtube.com/watch?v=20ceJJtfc34
৩। https://www.youtube.com/watch?v=pJnVGg8akI4 (৭.৩৫ মিনিট হতে ৭.৫৫ মিনিট পর্যন্ত)