ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত প্রতিরোধ কমিটির নামে পাহাড়ীদের সাথে ইউপিডিএফ (প্রসীত)’র প্রতারণার অভিযোগ - Southeast Asia Journal

ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত প্রতিরোধ কমিটির নামে পাহাড়ীদের সাথে ইউপিডিএফ (প্রসীত)’র প্রতারণার অভিযোগ

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত ও রক্তপাত বন্ধের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে কমিটি গঠনের নামে সাধারণ পাহাড়ীদের সাথে প্রতারণা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার অভিযোগ উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে। সংগঠনটির বিরুদ্ধে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নামে স্থানীয় হেডম্যান-কার্বারী ও পাহাড়ী জনগণের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের তালিকাভূক্ত করে কমিটি গঠনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে সংশ্লিষ্ট হেডম্যান-কার্বারী ও পাহাড়ী জনগণের মাঝে। ভূক্তভোগীরা বলছেন, নিজেদের মধ্যকার রক্তপাত বন্ধের নামে ইউপিডিএফ (প্রসীত) স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে চিরাচরিত তামাশা শুরু করেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৮ অক্টোবর বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পানছড়িতে ইউপিডিএফ (প্রসীত) সমর্থিত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শান্তি জীবন চাকমার নেতৃত্বে উপজেলার অজ্ঞাত কোন স্থানে একটি বৈঠক করে ইউপিডিএফ (প্রসীত) এর ১০-১২ জনের সশস্ত্র একটি দল। সেখান থেকে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও চিহ্নিত ইউপিডিএফ (প্রসীত) নেতা শান্তি জীবন চাকমাকে সভাপতি ও দলটির আরেক নেতা এবং লোগাং ইউপি চেয়ারম্যান প্রতুত্তর চাকমা সদস্য সচিব করে ১১৫জন সদস্য বিশিষ্ট ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত প্রতিরোধ কমিটির পানছড়ি উপজেলা শাখার অনুমোদন দেওয়া হয়। একই সাথে পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র রক্তপাত বন্ধে কমিটির ১১৫ সদস্যের একটি বিৃবতিও দেয়া হয়, তবে উক্ত কমিটিতে থাকা ১৪জন ইউপিডিএফ (প্রসীত) সদস্য ছাড়া কমিটির বাকি সদস্যরা এবিষয়ে এখনো অবগত নন বলে জানা যায়। এরপর গত ২৩ নভেম্বর সোমবারও একইভাবে জেলার দীঘিনালায়ও ৩৩ নং নুনছড়ি মৌজার হেডম্যান উদয় শংকর চাকমাকে সভাপতি ও প্রাক্তন ইউপি সদস্য কৃপা রঞ্জন চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে ৭১ সদস্য বিশিষ্ট ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এদিকে পানছড়িতে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও কমিটিতে উপজেলার বেশ কয়েকজন হেডম্যান-কার্বারী, ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্য ও সাধারণ পাহাড়ীকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি প্রচার হলে ক্ষোভ প্রকাশ করে তালিকায় থাকা হেডম্যান-কার্বারী ও ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বোগ প্রকাশ করেন। এরপর ২৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার পানছড়িতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্য, হেডম্যান-কার্বারী, গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ পাহাড়ীদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে পাহাড়ের আরেক আঞ্চলিক সংগঠন ও শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে থাকা ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। দুপুরে উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের দেওয়ানপাড়ায় সংগঠনটির অস্থায়ী কার্যালয়ে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর উপজেলা কমিটির সমন্বয়ক দীপন আলো চাকমার সভাপতিত্বে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সংগঠনটির জেলা কমিটির সদস্য ওম কান্তি দেওয়ান, সুবিনয় চাকমা, উল্টাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিজয় চাকমা, লতিবান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কিরণ ত্রিপুরা, উপজেলা কার্বারী এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হেম রঞ্জন কার্বারীসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, হেডম্যান-কার্বারী, গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ , দলীয় নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ পাহাড়ীরা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় উপস্থিত হেডম্যান-কার্বারীরা অভিযোগ করে বলেন, গত ৮ অক্টোবর বৃহস্পতিবার পানছড়িতে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো তালিকা তৈরী করে সেখানে স্থানীয় হেডম্যান-কার্বারীসহ সাধারণ পাহাড়ীদের নাম অন্তর্ভূক্ত করে প্রসীত পন্থি ইউপিডিএফ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তালিকায় থাকা লোকজনকে তাদের কথামতো কাজ করার হুমকি প্রদান করছে। ইউপিডিএফের (প্রসীত) খুন, গুম, অপহরণের মতো ঘৃন্য কর্মকান্ডে স্থানীয় হেডম্যান-কার্বারীদের আগ্রহ না থাকলেও জোরপূর্বক এসব সন্ত্রাসীরা স্থানীয়দের অপরাধের দিকে ঠেলে দেবার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলেও জানান তারা। এছাড়া ভবিষ্যতে প্রসীত পন্থি ইউপিডিএফের সকল অপতৎপরতা প্রতিরোধে সচেষ্ট থাকার অঙ্গীকারও করেন বক্তারা।

এসময় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর উপজেলা কমিটির সমন্বয়ক দীপন আলো চাকমা, প্রসীত পন্থি ইউপিডিএফ কর্তৃক অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার সাধারণ পাহাড়ীদের দিয়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানানোকে অপপ্রচার ও গণবিরোধী কার্যক্রম দাবি করে এসব প্রতারণা প্রতিরোধে সবাইকে সজাগ থাকার আহবান জানান। তিনি বলেন, ইউপিডিএফ বছরের পর বছর সাধারণ পাহাড়ীদের কাছে থেকে অবৈধ অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়, অপহরণ, খুনসহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ করে ইউপিডিএফ আবার অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে ঐক্যর নামে নতুন করে পাহাড়ে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চাইছে। সভায় উপস্থিত নেতৃবৃন্দ বলেন, প্রসীত বিকাশ খীসা ও তার দল ইউপিডিএফ সম্প্রতি নতুন ভাবে পাহাড়কে অশান্ত করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। তারা বলেন, “ইউপিডিএফের হাতে নিহত নিরীহ পাহাড়ীদের স্বজনরা কি ভাবে নিজেদের আত্নীয়-স্বজন হত্যার কথা ভূলে গিয়ে ইউপিডিএফের সাথে ঐক্য করবে?” তাদের মতে, সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে ব্যর্থ হয়েই ইউপিডিএফ ঐক্যের নামে পাহাড় নিয়ে নতুন চক্রান্ত করছে।

উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও তৎকালীন শান্তিবাহিনী (বর্তমানে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস)’র শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই যুগের সশস্ত্র সংঘাতের অবসান হলেও চুক্তির পরপরই পাহাড়ে গড়ে উঠে আরেক সংকট- ‘ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত’। সেসময় পার্বত্য চুক্তির বিরোধীতা করেই পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার নেতৃত্বে জন্ম নেয় পাহাড়ীদের আরেকটি নতুন দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। তাদের যুক্তি ছিলো, সরকারের সাথে পার্বত্য চুক্তি নয়, অস্ত্রের মাধ্যমে তারা পাহাড়ীদের অধিকার রক্ষা করবে, পাশাপাশি পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি জানাতে থাকে সংগঠনটি। ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আনুষ্ঠানিক এক কনভেনশনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে এবং বিরোধে জড়িয়ে পড়ে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস এর সাথে। পরবর্তীতে আবারো ভাঙনের মুখে পড়ে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন মূল জেএসএস। দলীয় নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়ন, স্বজন প্রীতি, সন্তু লারমার একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবসহ নানা বৈষম্যের অভিযোগে তৎকালীন জেএসএস নেতা রুপায়ন দেওয়ান, সুধা সিন্ধু খীসা, তাতেন্দ্র লাল চাকমাদের নেতৃত্বে গত ১০ এপ্রিল ২০১০ সালে গড়ে উঠে জেএসএস (এমএন লারমা) নামের নতুন আরেকটি সংগঠন। এরপর প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের আদর্শের বুলি শুনে সে দলে ভিড়তে থাকা নেতারাও কয়েক বছর পর আদর্শের নামে রক্তপাত, এলাকার দখলদারিত্ব, দখল নিয়ন্ত্রনে রাখতে স্বজাতি হত্যা, নেতা-কর্মীদের সাথে বৈষম্য, স্বেচ্ছাচারিতা, প্রতিপক্ষের কর্মসূচীতে বাধা প্রদানসহ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে নেতারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করছে অভিযোগ এনে ২০১৭ সালের ১৫ই নভেম্বর বেলা ১১টায় খাগড়াছড়ি জেলা সদরের খাগড়াপুর কমিউনিটি সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে ইউপিডিএফের প্রভাবশালী নেতা তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন সংগঠন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। ঐদিন তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে বলেছিলেন, আন্দোলন পরিচালনার কৌশল সঠিক না হওয়ার কারণে ইউপিডিএফের অনেক নেতা-কর্মী দল ত্যাগ করেছেন। দল ত্যাগ করার অপরাধে অনেক নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, বলপ্রয়োগের রাজনীতি, চাঁদাবাজি, গুম, খুন, অপহরণ, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় দিবস বর্জনের রাজনীতি করছে ইউপিডিএফ। তিনি বলেন, ‘ইউপিডিএফের অনেক নেতা এখন পকেট ভারী নেতা হিসেবে পরিচিত। মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি হয়ে নীতিহীন, আদর্শহীন, লক্ষ্যভ্রষ্ট, দুর্নীতিগ্রস্ত দলে পরিণত হয়েছে। এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করলে প্রতিবাদকারীদের আর্থিক দণ্ড ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ইউপিডিএফের বর্তমান নেতৃত্ব জুম্ম (পাহাড়ি) জনগণ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন বিরোধ থাকলেও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির সাথে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ’র সম্পর্ক বর্তমানে বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ বলে জানা গেছে। একটি সূত্রের দেয়া তথ্য মতে, সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির সাথে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ’র মধ্যে, নিজেদের মধ্যে রক্তপাত না ঘটনো এবং এলাকা ভাগাভাগি করে চাঁদাবাজি ও এলাকার নিয়ন্ত্রন ধরে রাখা নিয়ে একটি চুক্তি হয়েছে, যার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে এই দু’দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান বলে জানা গেছে।