কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইলেন মোদি
নিউজ ডেস্ক
শেষ পর্যন্ত ভারতের বিতর্কিত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রায় এক বছর ধরে ওই আইন নিয়ে আন্দোলন করছিলেন দেশটির কৃষকরা। শুক্রবার(১৯ নভেম্বর) জাতির উদ্দেশে ভাষণে এ কথা জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
তিনি বলেন, “আমি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইছি। আমি বলতে চাই যে, হয়তো আমাদের চেষ্টাতেই ঘাটতি ছিল। তাই কৃষি আইন প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এই মাসে শুরু হতে চলা সংসদ অধিবেশনে এই কৃষি আইন প্রত্যাহার করব।
আমি সবাইকে অনুরোধ করব, আসুন, আন্দোলন ছেড়ে একটি নতুন সূচনা করি। শীঘ্রই আইন প্রত্যাহারের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া পূর্ণ করে দেব। এবার আপনারা সকলে ক্ষেতে ফিরে যান, পরিবারের মাঝে ফিরে যান।”
শিখ ধর্মের প্রবক্তা গুরু নানকের জন্মদিনে মোদির এই ঘোষণা ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছেন ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একাংশ। কারণ কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লির উপকণ্ঠে অবস্থানকারী কৃষকদের বড় অংশই পাঞ্জাব এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের। তাদের মধ্যে শিখ এবং জাঠ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক। আগামী বছরের শুরুতেই পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোট।
নরেন্দ্র মোদি আরও বলেন, “আমি গত পাঁচ দশকে কৃষকদের দুর্গতি দেখেছি। তাই ২০১৪ সালে যখন দেশ আমাকে নির্বাচিত করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেয়, তখন থেকে ছোট কৃষকদের জন্যে কাজ করতে চেয়েছি। আজ কারোর ওপর দোষারোপ করার সময় নয়।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দেশের ছোট কৃষকদের কথা ভেবেই তিনটি কৃষি বিল আনা হয়েছিল। কৃষক সংগঠন, কৃষি অর্থনীতিবিদদের এই দাবি বহুদিনের। এর আগের সরকারও এ নিয়ে ভেবেছে। এরপরই সংসদে কৃষি বিল নিয়ে আলোচনা করে বিল পাস করানো হয়। কয়েক কোটি কৃষক এই বিলকে সমর্থন জানায়।
কিন্তু কৃষকদের স্বার্থে আনা এই বিল আমরা কয়েকজনকে বোঝাতে পারিনি। সেই কৃষকেরাই এর বিরোধিতা করছেন। তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি আমরা। আমরাও তাদের কথা বোঝার চেষ্টা করেছি। সরকার আইন বদলাতেও রাজি ছিল। এরই মাঝে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে চলে গেল।”
মোদির ঘোষণাকে স্বাগত জানাল রাজনৈতিক দলগুলো
কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ডান-বাম সবদলগুলিই। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরই টুইট করে কংগ্রেস নেতা ও পাঞ্জাবের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দার সিং বলেছেন, ‘বড় খবর। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।’
কংগ্রেসের তরফে টুইট করে বলা হয়েছে, ‘গর্বের পতন, আমাদের দেশের কৃষকদের জয়।’
টুইটারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যনার্জি লেখেন, ‘প্রত্যেক সংগ্রামী কৃষকদের আমার অভিনন্দন, এই আন্দোলনকারী কৃষকরা তাদের প্রতি হওয়ার কোনো নিষ্ঠুরতাতেই দমেননি। এটা আপনাদের জয়। এই লড়াইয়ে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের জন্য রইল গভীর সমবেদনা।’
টুইট করে সিপিআইএম’এর তরফে জানানো হয়েছে, ‘সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ও লাখ লাখ লড়াকু কৃষকদের অভিনন্দন।’
ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের নেতা রাকেশ টিকায়েত টুইট করে জানান, ‘এখনই কৃষক আন্দোলন প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। সরকার যেদিন সংসদে কৃষি আইন প্রত্যাহার করবে, সেদিনের জন্য অপেক্ষা করা হবে।’
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশটির সংসদে পাশ হয় এই তিন কৃষি আইন। এগুলি হল ‘দ্য ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড এন্ড কমার্স (প্রোমোশন এন্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট’, ‘দ্য ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট এন্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অব প্রাইস অ্যাসুরেন্স এন্ড ফার্ম সার্ভিসেস অ্যাক্ট’, দ্য এশেনসিয়াল কমোডিটিস (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট’।
কিন্তু বিতর্কিত তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে গত ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের হাজার হাজার কৃষকরা। সময় যত গড়িয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফে এই অরাজনৈতিক আন্দোলনকে সমর্থন জানানোয় কৃষকদের এই আন্দোলনের তীব্রতা তত বেড়ে যায়। বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে আবার সরাসরি ওই আন্দোলনে এসে যোগ দিতেও দেখা যায়। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে কয়েকজন কৃষক আত্মহত্যাও করেন। সমস্যা সমাধানে কৃষকদের সাথে কেন্দ্রের কয়েক দফায় আলোচনা হলেও সমাধান সূত্র অধরাই থেকে যায়।
এরই মধ্যে বিক্ষোভরত কৃষকদের হয়ে তিন কৃষি আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলাও হয়। তিন কৃষি আইনের বৈধতা নিয়ে কংগ্রেস, সিপিআইএম, তৃণমূল কংগ্রেস, আপ, এনসিপিসহ বিভিন্ন বিজেপি বিরোধী দলগুলি প্রশ্ন তুলে এই আইন প্রত্যাহারের দাবিও জানায়। স্বাভাবিক ভাবেই গোটা বিষয়টি ধীরে ধীরে অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে।
রাজনীতিকদের অভিমত আসলে সামনেই উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের মতো রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন। ভোটের আগে এই আইন প্রত্যাহার করা না হলে তার প্রভাব ভোটবাক্সে পড়তো। আর তা বুঝতে পেরেই এই আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের।