ব্যবসা গুটিয়ে মিয়ানমার ছাড়ছে একের পর এক বিদেশি কোম্পানি
নিউজ ডেস্ক
একের পর এক বিদেশি কোম্পানি মিয়ানমার থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। এবার সেই দলে যোগ দিয়েছে বিশ্বের জ্বালানি খাতের দুই বৃহৎ প্রতিষ্ঠান টোটাল ও শেভরন। রয়্যাল ডাচ শেলও জানিয়েছে, আপাতত সেখানে আর কোনো কার্যক্রম চালাবে না।
মিয়ানমারের সামরিক সরকারের অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ফরাসি প্রতিষ্ঠান টোটাল এনার্জিস ও যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন দেশটিতে তাদের কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গতকাল শুক্রবার এ ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠান দুইটি। দেশটির দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ইয়াদানা গ্যাস প্রকল্পে আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে যুক্ত ছিল টোটাল ও শেভরন।
প্রকল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়ার কারণ হিসেবে দুইটি প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারের সামরিক সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করেছে।
টোটাল এনার্জিস তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘‘২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মানবাধিকার, আইনের শাসনসহ মিয়ামারের পরিস্থিতির দিনকে দিন অবনতি হচ্ছে, যার কারণে আমরা পরিস্থিতি পুনঃমূল্যায়নে বাধ্য হয়েছি। আমরা মিয়ানমারের ইয়াদানা গ্যাস ক্ষেত্র এবং এমজিটিসি এর পরিচালনাকারী ও বিনিয়োগকারী হিসেবে টোটাল এনার্জিসের কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’
শেভরনের মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘মিয়ানমার পরিস্থিতি বিবেচনায় ইয়াদানা প্রাকৃতিক গ্যাস প্রকল্পে থেকে নিজেদের কার্যক্রম হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশটি ছাড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।’’
মিয়ানমারের এই প্রকল্পে সর্বোচ্চ ৩১.২৪ শতাংশের মালিক টোটাল। অন্যদিকে, তাদের অংশীদার শেভরনের রয়েছে ২৮ শতাংশ মালিকানা। বাকিটা মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কোম্পানির মালিকানাধীন।
এদিকে, রয়্যাল ডাচ শেলও মিয়ানমারে তাদের কার্যক্রম বন্ধের খবর শুক্রবার নিশ্চিত করেছে। সমুদ্রে একটি ব্লকে উডসাইড এনার্জি ও মিয়ানমার পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানির সঙ্গে তাদের যৌথ বিনিয়োগ কার্যক্রম ছিল ৷
রয়টার্সকে প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র বলেন, ‘‘অনুসন্ধান কাজ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। যার কারণে এর সঙ্গে কোনো উৎপাদন, আর বা সরকাররে সঙ্গে আমাদের কোনো লেনদেনও নেই।’’
শুধু এই তিন প্রতিষ্ঠানই নয় একে একে প্রায় সব বিদেশি বৃহৎ কোম্পানিই মিয়ানমার থেকে তাদের বিনিয়োগ গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে আরো বিপাকে পড়ছে দেশটির অর্থনীতি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, শুধু টোটাল ও শেভরনই ইয়াদানা গ্যাস প্রকল্পের আয় থেকে সরকারকে বছরে একশো কোটি ডলারের বেশি দিত কর ও বিভিন্ন ফি হিসেবে, যা দেশটির বিদেশি মুদ্রা আয়ের এককভাবে সবচেয়ে বড় উৎস ছিল।
জ্বালানি খাতে ফ্রান্সের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ইডিএফ দেশটিতে ১৫০ কোটি ডলারের একটি যৌথ বিনিয়োগের পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পে জড়িত ছিল। তারা সেখান থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। মিয়ানমার ছেড়েছে ফরাসি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রতিষ্ঠান ভোল্টালিয়াও।
মিয়ানমারে সবচেয়ে বড় টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক নরওয়ের টেলিনর। তারাও গত বছর দেশটিতে তাদের ব্যবসা বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দেয়। চলতি সপ্তাহে একটি বার্মিজ ডিজিটাল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে তারা শেয়ার হস্তান্তর করবে।
গত অক্টোবরেই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোবাকো। দেশটিতে তাদের কর্মী বহরে ছিল এক লাখেরও বেশি মানুষ।
জাপানি প্রতিষ্ঠান টোয়োটার মিয়ানমারে গত বছরই একটি কারখানা চালু করার কথা ছিল। সেটি তারা স্থগিত করেছে। সামরিক সরকার ক্ষমতা দখলের পরপরই দুইটি কারখানার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে আরেক জাপানি গাড়ি নির্মাতা সুজুকি।
সামরিক অভ্যুত্থানে ধাক্কায় গত কয়েক বছর ধরে ক্রমবর্ধিষ্ণু তৈরি পোশাক শিল্পও। ইতালির বেনেটনের মতো ব্র্যান্ডগুলো এখন তাদের কাছ থেকে পোশাক কেনা বন্ধ করে দিয়েছে।
জাপানের পানীয় পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কিরিন গত কয়েক মাস ধরেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্কের ইতি টানার চেষ্টা করে আসছে।
ডেনিশ বহুজাতিক কোম্পানি কার্লসবের্গের প্রায় সাড়ে চারশো কর্মী আছে দেশটিতে। প্রতিষ্ঠানটি সেখানে কার্যক্রম সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে।
সব মিলিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধে বিদেশি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও মিয়ানমারের সার্বিক অর্থনীতি আরো নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। যদিও সরকারের দাবি বিদেশি কোম্পানিগুলো কার্যক্রম গুটিয়ে নিলেও দেশটির অর্থনীতিতে তার বড় প্রভাব পড়বে না৷