হাইকোর্টের নির্দেশে পাহাড়জুড়ে বন্ধ হচ্ছে সব অবৈধ ইটভাটা
![]()
নিউজ ডেস্ক
গত ২৫ জাুনয়ারি মঙ্গলবার খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটি—পার্বত্য চট্টগ্রামের এই তিন জেলায় থাকা সব অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম সাত দিনের মধ্যে বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সেখানে থাকা লাইসেন্সহীন সব ইটভাটার তালিকা আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে তিন জেলার জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম এলাকার পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালকসহ বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি ফাতেমা নজীবের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি দিন রাখা হয়েছে।
এ আদেশ পাওয়ার পর দ্রুততার সাথে অবৈধ সব ইটভাটা চিহ্নিত করে তা বন্ধ করার কাজ শুরু করে দিয়েছে তিন পার্বত্য জেলার প্রশাসন।

এরই ধারাবাহিকতায়, গত বৃহস্পতিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের ১১টি ও আলিকদমে ১টি ইটভাটাকে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে বন্ধ করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এসময় এই ১২ ইট ভাটাকে মোট ১৬ লক্ষ টাকা জরিমানাও করা হয়।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মো. কায়েসুর রহমান ও মো. মামুনুর রশিদের নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে সহযোগিতা করেন বান্দরবান পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক আশফাকুর রহমান, লামা থানার এসআই শাহীন পারভেজসহ সঙ্গীয় ফোর্স ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন।
এসময় লামার ফাইতং ইউনিয়নের ফরিদুল আলমের মালিকানাধী এফএসিকে ২ লক্ষ টাকা, মো: ইউনুসের মালিকানাধীন এসবিডাব্লিউকে ২ লক্ষ টাকা, মোকতার আহমেদের মালিকানাধীন এমএসবিকে ২ লক্ষ টাকাসহ আরো ৮টি ব্রিকফিল্ডকে ১ লক্ষ টাকা করে মোট ১৪ লক্ষ টাকা এবং আলিকদমের পূর্বপালং পাড়ার এফবিএম নামের একটি ইটভাটাকে ২ লক্ষ টাকা জরিমানা করেন। তাছাড়াও এই ইটভাটাগুলোর বিভিন্ন অংশে আংশিকভাবে ভেঙ্গে দেওয়ার পাশাপাশি কাঁচা ইট নষ্ট এবং ইটভাটাগুলো বন্ধ ঘোষনা করে নোটিশ টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়।

এছাড়া শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় ৬টি ইটভাটাকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে এসব ইটভাটাকে বন্ধ ঘোষনা করে সিলাগালা করেন,মাটিরাঙ্গা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ভ্রম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মিজ আফরোজা হাবিব শাপলা।
এসময় মেসার্স এবিএম, মাটিরাঙ্গা পৌরসভার ইসলামপুর। এ সেভেন সেভেন, নতুনপাড়া। থ্রি-ফল্ড আর, নতুনপাড়া। থ্রি-ফল্ড ফাইভ, ওয়াসু। বিআরএস, আদর্শ গ্রাম, থ্রি-ফল্ড সিক্স, আদর্শ গ্রাম এসব অবৈধ ইটভাটাকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় একই সাথে এ সকল ইটভাটাকে সিলগালা করে দেয়ার পাশাপাশি লাল পতাকা টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়।
এর আগেও মাটিরাঙ্গা পৌর এলাকায় অবস্থিত মোট ৬টি ইটভাটাকে লাইসেন্স বিহীন অবৈধভাবে ইটভাটা স্থাপন করার দায়ে ৫লাখ টাকা জরিমানা করে উপজেলার ভ্র্যম্যমান আদালত।

এরপর, আজ শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় অবৈধভাবে গড়া ওঠা আরও ৬ ইটভাটা সীলগালা করে দিয়েছে মাটিরাঙ্গা উপজেলা প্রশাসন। এনিয়ে মাটিরাঙ্গায় চলমান ১২টি ইটভাটা সীলগালা করে দিল মাটিরাঙ্গা উপজেলা প্রশাসন। দুপুরের দিকে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করেন মাটিরাঙ্গার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আফরোজা হাবিব শাপলা।
এসময় ইটভাটাগুলোতে হাইকোর্টের নির্দেশনা সম্বলিত ব্যানার ও লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়ে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষনা করা হয়।

একই দিন, জেলার পানছড়ি উপজেলার ৩টি ইটভাটা বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। সকাল দশটায় এ আদেশ জারী করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবাইয়া আফরোজ। উপজেলার নালকাটা এলাকায় সততা, এমএসআর ও লোগাংয়ে সেলিম এন্ড ব্রাদার্স নামের ইটভাটা তিনটির অবস্থান। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন নং-১২০৪/২০২২ এর আদেশ মোতাবেক ইট ভাটার (পানছড়ি উপজেলা) সকল কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষনা করা হয় বলে জানা যায়।

এদিন, জেলার সাবেক মহকুমা শহর রামগড়ে অবৈধভাবে গড়ে উঠা ৯টি ইটভাটা সিলগালা করে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। সকালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ইটভাটাগুলোতে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দিয়ে লাল পতাকা টাঙিয়ে সিলগালা করে দেওয়া হয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার খোন্দকার মো. ইখতিয়ার উদ্দিন আরাফাত ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) উম্মে হাবিবা মজুমদার এ অভিযান চালান।
অভিযানে রামগড় পৌরসভার ফেনীরকুল এলাকার নুর ইসলাম, হাফেজ আহাম্মদ, মোস্তফা ভূঁইয়া ও আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন ৪টি এবং তাছড়া ইউনিয়নের দাতারাম পাড়া এলাকার মেগনা ১ ও ২, আপন, জনতা ও এসএস আরও ৫টি ইটভাটা সিলগালা করে দেন নির্বহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।

অন্যদিকে, জেলার গুইমারা উপজেলায়ও ৫টি ইটভাটাকেও বন্ধ করে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন পরিচালিত ভ্রাম্যমান আদালত। দুপুরে এ ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তুষার আহমেদ।

জেলার দীঘিনালাতেও এদিন দুটি ইট ভাটা পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেয় উপজেলা প্রশাসন। দুপুরে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে হেডম্যান পাড়ার এডিবি ব্রিক ফিল্ড ও রসিকনগরের মেসার্স সেলিম এন্ড ব্রাদার্স ভাটাকে বন্ধ ঘোষনা ও সেখানে লাল পতাকা টাঙিয়ে সিলগালা করে দেওয়া হয়।
এছাড়া, জেলার মানিকছড়ি উপজেলায় দুইটি ইটভাটা বন্ধ ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রশাসন। বিকেলে উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুম্পা ঘোষ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ইটভাটা দুইটিতে সিলগালা করেন।

রাঙামাটিতেও হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে জেলা ও বিভিন্ন উপজেলা প্রশাসন।

শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার দুই ইটভাটাকে ৪০ হাজার টাকা ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানার পাশাপাশি বন্ধ করে দিয়েছে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শরিফুল ইসলাম।
উপজেলার অবস্থিত এম এম সি পক্ষে মোঃ সোহাগকে ২০ হাজার টাকা ও কে বি এম পক্ষে মোঃ নাহিদ’কে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং দুইটি ইট ভাটা বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন।
জেলা প্রশাসনগুলো জানায়, হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সমস্ত অবৈধ ইট ভাটা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। এসব ইটভাটা সম্পুর্ন অবৈধ প্রক্রিয়ায় জেলা প্রশাসকের অনুমতি ব্যতিত কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে এবং ভাটায় কাঁচামাল হিসেবে কৃষি জমির উপরিভাগের (টপসয়েল) মাটি ব্যবহার ও জ্বালানী হিসেবে বনের কাঠ ব্যবহার করায় ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, লঙ্ঘন করায় প্রতিটি ইটভাটার মালিককে জরিমানা ও বন্ধ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, তিন পার্বত্য জেলায় থাকা বিভিন্ন ইটভাটা লাইসেন্স ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে। পাহাড় কেটে মাটি ইটভাটার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার ও বনের গাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে—গণমাধ্যমে আসা এমন খবর যুক্ত করে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে কয়েকদিন আগে হাইকোর্টে রিটটি করা হয়। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
পরে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ওই তিন জেলায় থাকা লাইসেন্সহীন সব ইটভাটার কার্যক্রম আগামী সাত দিনের মধ্যে বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের দুই সপ্তাহের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রুলে তিন জেলায় লাইসেন্সহীন পরিচালিত সব ইটভাটা বন্ধে নিষ্ক্রিয়তাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং অবৈধভাবে পরিচালিত ইটভাটার মালিকদের বিরুদ্ধে ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধান অনুসারে ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। পরিবেশ সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, চট্টগ্রামের পরিচালক, তিন জেলার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ ২৪ বিবাদীকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।