খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়িতে ইট গাথুনির বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজ
নিউজ ডেস্ক
মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ভূমি ও গৃহহীন পরিবারে আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুই শতক ভূমি দান করে তাতে লাল-সবুজ টিনে দুই কক্ষ বিশিষ্ট সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করে বিশ্বে নজির সৃষ্টি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতার এই দান খাগড়াছড়ি জেলার অনগ্রসর উপজেলা লক্ষ্মীছড়ির সুবিধাভোগী পরিবারের অনেকে সেটি পেতে নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘর নির্মাণে ডিজাইন না মেনে দায়সারা ভাবে নিন্মমানের মালামাল ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেকের ঘরে ইট গাতুঁনিতে বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো ঘরে টিন লাগেনি। এছাড়া এক-তৃতীয়াংশ ঘরে টয়লেট সুবিধাও রাখেনি ঠিকাদার। অনুন্নত জনপদে নিরবে মহৎ প্রকল্পে গুরুত্বর অনিয়ম হলেও বিষয়টি আমলেই নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন।
সরজমিন ও সুবিধাভোগীর তথ্যে জানা গেছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ২০২০ এর পূর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের আশ্রয় নিশ্চিত করতে দুই শতক ভূমিসহ দুই কক্ষ ও বারান্দা এবং ঘরে টয়লেট সুবিধা দিয়ে লাল-সবুজ টিনে সেমিপাকা ঘর বরাদ্দ করেন।
খাগড়াছড়ি জেলার অন্যান্য উপজেলার ন্যায় অনগ্রসর জনপদ লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার তিন ইউনিয়নের মধ্যে লক্ষ্মীছড়ি সদর ইউপিতে ৩৩২ পরিবার, দুল্যাতলী ইউপিতে ১৯১ পরিবার ও বার্মাছড়ি ইউপিতে ১৭৭ পরিবারসহ মোট ৭০০ পরিবার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে সুবিধা প্রাপ্তির তালিকায় অর্ন্তভুক্তি হয়। নির্মাণ কাজে ঠিকাদার প্রতি ঘরে ৩০ বস্তা সিমেন্ট, ১৩ কেজি রড, সিংহভাগ সুবিধাভোগী থেকে কাঠ নিয়ে দায়সারাভাবে এবং কচ্ছপগতিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ৮০শতাংশ সুবিধাভোগীরা কোন ঘরেই টয়লেট পায়নি। ক্ষুদ্র নৃ গোষ্টিরা ঘরে টয়লেট ব্যবহারে অনিহা থাকার অজুহাতে ঠিকাদার টয়লেট সুবিধা বাদ দিয়েছেন। উপজেলা সদরের দৃশ্যমান জায়গার ঘরের কাজে কিছুটা নিয়ম মানলেও দূর্গম বার্মাছড়ি ও দুল্যাতলীতে চরম অনিয়ম হয়েছে। সাব ঠিকাদারেরা প্রতি ঘরে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৩০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকায় কাজ শেষ করেছেন!
বার্মাছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নীল বর্ণ চাকমা বলেন, এখানে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘর নির্মাণে অনিয়ম হচ্ছে। বার্মাছড়িতে কারও ঘরেই টয়লেট সুবিধা দেওয়া হয়নি। সুবিধাভোগীরা গাছ ও অনেকে নগদ টাকা দিতে হয়েছে। এসব অন্যায়ে সাব ঠিকাদারেরা জড়িত।
সম্প্রতি দুল্যাতলী ইউনিয়নের মগাইছড়ি, মারমাপাড়া, নতুনপাড়া গিয়ে দেখা গেছে, আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে চরম অন্যায়ের আশ্রয় নিয়েছেন ঠিকাদার তালাত মাহমুদ শিশির। নতুনপাড়ার অসহায় প্রতিবন্ধী (অন্ধ) মো. সিরাজুল ইসলামের শারিরিক এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে ইউএনও মোহাম্মদ ইয়াছিন গত রমজান মাসে একটি ঘর বরাদ্দ করেন। কিন্তু ঠিকাদার এই অসহায় পরিবারে ৫০০০ ইট, ৩০ বস্তা সিমেন্ট ও ১৩ কেজি রড এনে গত এক বছরে ইটের গাতুৃনি তুলে কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। অসহায় মো. সিরাজুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী রাহিমা বেগম জানান, ইউএনও স্যার আমার শারিরিক ও পারিবারিক অবস্থা দেখে প্রধানমন্ত্রীর উপহার আমাকে দিয়েছে। কিন্তু ঠিকাদার কাজ অর্ধেক করে আমার কাছে ১০০০০ টাকা দাবী করেন। এমনিতে আমি তিন বছর ধরে অন্ধ হয়ে আছি। এর মধ্যে কিভাবে তাকে টাকা দেই? না দেওয়াতে গত এক বছরেও আমার ঘরের কাজ শেষ হলো না। আমি স্ত্রী, মেয়ে নিয়ে রানা ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করি।
মারমা পাড়া উদ্রাচাই মারমা জানান, ঘরের কাজ করতে আমি ৪ বস্তা সিমেন্ট ও কিছু গাছ দিয়েছি। কিন্তু ঘরের কাজ ভাল হয় নাই, ফ্লোর, দেয়াল ফেঁটে গেছে।
মগাইছড়ির মো. মামুন হোসেন অভিযোগ করে বলেন, এই এলাকায় প্রায় ১০০ ঘরের কাজ নিয়েছেন উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতা তালাত মাহমুদ শিশির। তিনি নিজ এবং ইউএনওর দাপট দেখিয়ে দায়সারাভাবে নিন্মমানের ইট, পাথর মিশ্রিত বালু, ৩০ বস্তা সিমেন্ট, ১৩ কেজি রড দিয়ে কাজ করছেন। গত ৮/৯ মাস আগে আমার বাড়িতে একই হারে মালামাল রেখে যায়। গত ১২ ফেব্রুয়ারী কাজ শুরু করেন। এতে সিমেন্টের বস্তাগুলো পাথর হয়ে গেছে, এগুলো দিয়েই কাজ চালাচ্ছেন। প্রতিবাদ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, বেশি বাড়াবাড়ি করলে বিপদে পড়বা।
উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক তালাত মাহমুদ শিশির দাবী করেন, দানের ঘরে সরকার যা বরাদ্দ করেছে, সে অনুযায়ী কাজ করছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজে এসব কাজ তদারকি করেন। এখানে বিন্দুমাত্র অনিয়ম হচ্ছে না।
উপজেলার সাবেক এক ভাইস চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে লক্ষ্মীছড়িতে চরম দুর্নীতি হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকে প্রতিবাদ করায় নানা হয়রানীমূলক মামলার শিকার হয়েছেন। জনগণের রক্ষক যেখানে ভক্ষকের ভূমিকা নেয়, সেখানে অন্যায়ের প্রতিবাদ বা দুর্নীতি বন্ধ করবে কে?
এ বিষয়ে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ ইয়াছিনের বক্তব্য জানতে তার ব্যবহৃত সরকারী মোবাইল নম্বরে (০১৫৫০৬০৪৫২৬) কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেন নি কিংবা পরবর্তীতেও কোন সাড়া দেন নি।