ভয়াবহ খাদ্যসংকটের মুখে শ্রীলঙ্কা, দুই বেলার খাবারের দাবিতে বিক্ষোভে বাড়ছে সমর্থন - Southeast Asia Journal

ভয়াবহ খাদ্যসংকটের মুখে শ্রীলঙ্কা, দুই বেলার খাবারের দাবিতে বিক্ষোভে বাড়ছে সমর্থন

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

শ্রীলঙ্কার কৃষক মাহিন্দা সামারাবিক্রমা (৪৯) এ মৌসুমে ধান চাষ করবেন না। সরকারের পক্ষ থেকে রাসায়নিক সার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পর গত মৌসুমে তাঁর ধানের ফলন অর্ধেকে নেমে যায়। গত মার্চে তিনি ২০ একর জমিতে ধান ও কলা লাগান। মাহিন্দা জানান, কৃষি খামার চালানোর মতো কোনো অর্থ নেই। ধানের পাশাপাশি তিনি কলা চাষ করেও ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন।

আল–জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, অর্গানিক কৃষির জন্য সরকার সার আমদানি বন্ধ করে দেওয়ায় মাহিন্দার মতো কৃষকেরা বিপাকে পড়েন। সার না দেওয়ায় ফলন অনেক কমে গেছে। আর খাদ্য আমদানি করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ সরকারের নেই। ফলে ভয়াবহ খাদ্যসংকটের মুখে দেশটি।

শ্রীলঙ্কার দক্ষিণে হাম্বানটোটা জেলার বাসিন্দা মাহিন্দা। সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত কলাবাগান দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরোপুরি লোকসান তাঁর। কলাগাছ ঠিকমতো বেড়ে ওঠেনি। যখন এর দিকে তাকাই, তখন বুঝতে পারি স্বাভাবিক ফলন পাব না।’ এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, বছরে তিনি ৩৭ হাজার কেজি কলার ফলন পান। কিন্তু এবার ছয় হাজার কেজি পাবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

মহিন্দা বলেন, ‘সবকিছু ভেঙে পড়েছে। কী করব জানি না। একবার আকাশের দিকে আর একবার জমির দিকে তাকিয়ে শুধু অপেক্ষা করছি।’

জেলার সামারাবিক্রমার গ্রামের অধিকাংশ প্রান্তিক কৃষকও মাহিন্দার সুরে কথা বললেন। তাঁরা এ মৌসুমে আর ফসল ফলাতে চান না। মে থেকে আগস্ট দেশটির ফসল বোনার সময়। কিন্তু এখন আর মাঠে সেচ দিতে চাইছেন না কৃষকেরা। তাঁরা বলছেন, রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করায় ফসল ফলছে না। এর বাইরে জ্বালানি–সংকটের কারণে চাষ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

দেশটির ‘মুভমেন্ট ফর ল্যান্ড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার রিফর্ম নামের বেসরকারি সংগঠন বলছে, হাম্বানটোটা জেলার অধিকাংশ প্রান্তিক কৃষক এবং উত্তরাঞ্চলের অনুরাধাপুরা ও পোলোনারুয়ার মতো কৃষিপ্রধান অঞ্চলের কৃষকেরা এ মৌসুমে তাঁদের চাষাবাদ বন্ধ রাখছেন।

এ অবস্থায় খাদ্যসংকটে ভুগতে থাকা শ্রীলঙ্কা আরও বেশি অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রপ্তানি পণ্যের পাশাপাশি দেশটি স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন খাদ্যশস্য–সংকটেও পড়ে যেতে পারে।

শ্রীলঙ্কা কাউন্সিল ফর অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ পলিসির প্রেসিডেন্ট গামিনি সেনানায়েকে বলেন, ‘খাদ্যের দিক থেকে আগামী কয়েক মাস খুব কঠিন সময় আসবে। খাদ্যসংকট দেখা দেবে। আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’

২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার দ্বীপরাষ্ট্রটি একসময় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। কিন্তু গত মে মাসে দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের ঘোষিত বিশ্বের প্রথম অর্গানিক বা জৈব কৃষিনীতির কারণে ভুগতে থাকে দেশটি। তাঁর নীতির কারণে দেশটিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক নিষিদ্ধ করা হয়। এতে দেশটির খাদ্যনিরাপত্তা মারাত্মক হুমকিতে পড়ে যায়। মাটি ভালো রাখার পাশাপাশি কৃষকদের কিডনি রোগ ঠেকাতে রাতারাতি রাসায়নিক সার ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে গোতাবায়ার প্রশাসন।

দেশটির ২০ লাখ কৃষক আকস্মিকভাবে মহাবিপদে পড়ে যান। তাঁদের অভিযোগ, সরকার প্রয়োজনীয় জৈব সারের উৎপাদন না বাড়িয়েই এ সিদ্ধান্ত নেয়। এতে গত মার্চের শেষে দেশটিতে কৃষিপণ্যের উৎপাদনে ব্যাপক ধস নামে। ওই সময়টিকে শ্রীলঙ্কার ‘মাহা’ মৌসুম বলা হয়। এ মৌসুমে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ঠিক কতটা কমেছে, তার সরকারি হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, ফলন ২০ থেকে ৭০ ভাগ কম হয়েছে। শ্রীলঙ্কার প্রধান খাদ্যশস্য ধানের উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমেছে। এ বছরের প্রথম তিন মাসে তাই দেশটিকে তিন লাখ টন চাল আমদানি করতে হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালে দেশটি মাত্র ১৪ হজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করেছিল।

অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে সরকার প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে না। এর মধ্য রয়েছে জ্বালানি ও ওষুধ। সংকট থেকে দেশটির মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেছে। মানুষ ডিজেল পেতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ থাকছে না ১৩ ঘণ্টার বেশি। ওষুধের অভাবে মানুষের ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা। হাজারো মানুষ শাসনক্ষমতায় থাকা রাজাপক্ষে পরিবারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। এর জের ধরেই মন্ত্রিসভায় থাকা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষেসহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা পদত্যাগ করেন। তবে প্রেসিডেন্ট পদত্যাগের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন।

শ্রীলঙ্কার পেরাদেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের অধ্যাপক জিউইকা ওয়েরাহেওয়া বলেন, মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের ফলে দেশে শৈশবকালীন অপুষ্টি এবং অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের মধ্যে অপুষ্টি সমস্যা দেখা দেবে। আগামী চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে আমাদের আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে।

এদিকে শ্রীলঙ্কার সরকারি দলের দুজন সংসদ সদস্যকে (এমপি) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত সপ্তাহে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগে গতকাল তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। দেশটিতে কয়েক দিন ধরে চলা বিক্ষোভ–সহিংসতায় ৯ জন নিহত হয়েছেন।

দুই বেলার খাবারের দাবিতে বিক্ষোভ
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। দুই বেলা খাবারের দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন বেকারসহ অসংখ্য মানুষ। বুধবার ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআই এক প্রতিবেদনে এমন কথা তুলে ধরেছে।

চলমান সংকটে কাজ হারিয়ে বেকার হওয়া এবং কয়েকশ’ দিনমজুর কলম্বোতে খাবার নেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়েছেন। এখানে কলম্বোভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান খাবার সরবরাহ করছে।

সমাজকর্মী আকুশলা ফার্নান্দো বলেন, ৯ এপ্রিল থেকে আমরা খাবার বিতরণ করছি। আমরা চাই প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করুন। তিনি জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছেন না এবং দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হচ্ছেন।

তিনি জানান, তাদের ট্রাস্ট বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ, পণ্য ও খাদ্য গ্রহণ করছে। এখন পর্যন্ত আমরা হাজারো মানুষকে খাবার বিতরণ করেছি।

আকুশলা বলেন, কাজ করছেন এবং বেকার থাকা অনেক মানুষ এখানে আসছেন। চলমান বিক্ষোভের কারণে কাজ হারানো মানুষেরাও আসেন। তারা বলছেন, কাজ চলে যাওয়া নিয়ে তারা ভাবছেন না, তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিক্ষোভ করছেন।

শ্রীলঙ্কা বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এত শোচনীয় যে তা অতীতে দেখা যায়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশজুড়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ।

ট্রাস্ট কর্তৃক সরবরাহ করা খাবার বিতরণে জড়িত আরেক ব্যক্তি শেরভিন রানাতুঙ্গা জানান, শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে মানুষ আসছেন। বাস, ট্যাক্সি ও ট্রেনে চড়ে অনেকে আসছেন। আমরা সবাইকে খাবার দিচ্ছি।

তিনি বলেন, ধনী ও গরিব বৈষম্য না করে আমরা সবাইকে খাবার দিচ্ছি।

দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে জরুরি খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংকট প্রকট আকার ধারন করেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশটির বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও কমে গেছে। বিশেষ করে করোনা মহামারিতে পর্যটন খাতে ধস নামায় বিদেশি মুদ্রা আয় হয়নি। ফলে দেশটি পর্যাপ্ত জ্বালানি ও গ্যাস কিনতে পারছে না অর্থের অভাবে। মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পাচ্ছে না।

সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শ্রীলঙ্কার নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন জনগণকে আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে।

সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সহিংসত সংঘর্ষের পর গত সপ্তাহে পদত্যাগ করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে।