প্রজ্ঞাপন জারি করে পাহাড়ের সবচেয়ে বড় সেতুর নামকরণ, ক্ষোভ স্থানীয়দের
নিউজ ডেস্ক
প্রজ্ঞাপন জারি কেরে ২০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় সেতু রাঙামাটির নানিয়ারচর সেতুটির নামকরণ করেছে সরকার।
৩ জানুয়ারি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে সরকারের সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রনালয়ে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সম্পত্তি শাখার সিনিয়র সহকারী সচিত মোঃ গোলামী জিলানী কর্তৃক স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নানিয়ারচর সেতুটিকে বিশিষ্ট চিত্রশিলপী ‘বাবু চুনীলাল দেওয়ান সেতু’ নামে নামকরণ করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, রাঙামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়ারচর উপজেলাধীন সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের রাঙামাটি সড়ক বিভাগাধীন বগাছড়ি-নানিয়ারচর-লংগদু জেলা মহাসড়ক (জেড-১৬১২)-এর ১০ কিলোমিটারে নির্মিত নানিয়ারচর সেতুটির নাম চিত্রশিল্পী “বাবু চুনিলাল দেওয়ান সেতু” নামে সরকার নামকরণ করলেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কল্যাণে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে শুক্রবার। এর পরপরই বিষয়টি নিয়ে পাহাড়ের নেটিজেনরা অনলাইনে-অফলাইনে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের ছাত্র সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের নেতা-কর্মীরা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সেতুটি বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের নামে নামকরণ করার দাবিও জানিয়েছেন।
এর আগে, গত বছরের ১২ জানুয়ারি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে বহুল কাঙ্খিত এই সেতুন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই স্থানীয় অধিবাসীরা সেতুটিকে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ এর নামে নামকরণের দাবি জানিয়ে আসছে।
তবে, যে চুনীলাল দেওয়ানের নামে এই সেতুর নামকরণ তিনি ছিলেন একজন চিত্রশিল্পী এবং সাহিত্যিক। তিনি বিখ্যাত বাংলাদেশী চিত্রকর জয়নুল আবেদীন এর সহকর্মী ছিলেন।
এমনকি, নানিয়ারচর উপজেলার চেঙ্গী নদীর উপর নির্মিত রাঙামাটি-নানিয়ারচর সেতুর নাম বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ’র নামকরণের দাবিতে সেতুটি উদ্বোধনের আগে ২০২০ সালের ২৭ জুলাই সোমবার রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দেয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, রাঙামাটি জেলা শাখা।
স্থানীয়রা বলছেন, রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় শায়িত আছেন বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ। এই বীবের নামে রাঙামাটিতে তেমন বড় কোন ধরনের স্থাপনার নামকরণ করা হয় নাই। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পুরণের এই সেতুর নাম বীরশ্রেষ্ঠের নামে নামকরণ করলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেমন রক্ষা করা যাবে, তেমনই এই বীরশ্রেষ্ঠের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের ক্ষুদ্র প্রয়াসও স্বার্থকতা পাবে।
এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের রাঙামাটি জেলা সভাপতি হাবিব আজম বলছেন, সরকারের উক্ত প্রজ্ঞাপনটি দেখে পার্বত্য এলাকার ছাত্রসমাজ অত্যন্ত ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ রাঙামাটি জেলা শাখা সরকারের কাছে পার্বত্য এলাকার আপামর ছাত্র জনতার আবেগ অনুভূতিকে মূল্যায়ণ করে উক্ত প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করার জোর দাবি জানাচ্ছি। কারণ উক্ত সেতুটির পাশে ঘুমিয়ে আছেন বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ। তার সম্মানে উক্ত সেতুটি “বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ সেতু” নামে নামকরণ করার জন্য পার্বত্যবাসী দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলো। কিন্তু সাধারণ পার্বত্যবাসীর দাবিকে পাশ কাটিয়ে সেতুটি অন্য নামে নামকরণ করা হলো। এতে পার্বত্য এলাকার ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণ খুবই মর্মাহত হয়েছে।
নানিয়ারচরের স্থানীয় এক বাসিন্দা রুপায়ন চাকমা জানান, যে নানিয়ারচরের মাটিতে একজন বীরশ্রেষ্ঠ শায়িত রয়েছেন, সেই মাটির উপরে একটি সেতুর নামকরণ করা হচ্ছে অন্য নামে যা আমরা রাঙামাটিবাসী। সেতুটির নাম পরিবর্তন করে “বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ সেতু” নামে পুনরায় নামকরণ করলে আমরা নানিয়ারচরবাসী হিসেবে সরকারের নিকট কৃতজ্ঞ থাকবো।
তবে সরকারী ছুটির দিন হওয়ায় এ বিষয়ে কথা বলতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখসারিতে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে ৭ জন বীরকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ খেতাব “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাঁদের অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি নিয়মিত পদাতিক সৈন্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল (মতান্তরে ২০ এপ্রিল) তিনি মর্টার শেলের আঘাতে শহিদ হন। তাঁকে রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাটে একটি টিলার ওপর সমাহিত করা হয়।
প্রসঙ্গত, ১৯৬০ সালে কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির পর থেকেই চেঙ্গী নদীর ওপর সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিল স্থানীয় অধিবাসীরা। রাঙামাটি সদর-নানিয়ারচর-লংগদু-বাঘাইছড়ি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ১৯৯৩ সালে নানিয়ারচর অংশে চেঙ্গী নদীর ওপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সেখানে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। দুই বছর পর ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সেতু নির্মাণ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে ইসিবি। এর কার্যাদেশ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মনিকো লিমিটেড। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৫০০ মিটার ও প্রস্থ ১০ দশমিক ২ মিটার। সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সেতুর দুই পাশে দুই কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ ব্যয় হয়েছে আরও ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণের কাজে।