সেনাবাহিনীর ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তারা
নিউজ ডেস্ক
যশোরের চৌগাছা উপজেলার শমসের আলীর ছেলে রাসেল হোসেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিস সহায়ক পদে চাকরির জন্য ২০০৯ সালে সাত লাখ টাকা দেন এক প্রতারক চক্রের হাতে। চক্রটি সাক্ষাৎকার শেষে গত বছরের ২৩ জানুয়ারি নিয়োগপত্র দেয় রাসেলকে। ওই নিয়োগপত্রে যোগদানের কথা উল্লেখ ছিল গত বছরের ১৪ জানুয়ারি। চাকরিতে যোগ দিতে গিয়ে রাসেল বুঝতে পারেন নিয়োগপত্রটি ভুয়া।
একইভাবে বাংলাদেশ সচিবালয়ে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরির জন্য ওই চক্রকে সাত লাখ টাকা দেন যশোরের চৌগাছা উপজেলার বুরিন্দিয়া গ্রামের বাসিন্দা সজিব হোসেন। ২০২১ সালের ১৮ মার্চ সজিবকে নিয়োগপত্র দেয় চক্রটি। চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে সজিবও দেখেন নিয়োগপত্রটি ভুয়া।
এই চক্রের কাছ থেকে ভুয়া নিয়োগপত্র নিয়ে প্রতারিত হয়েছেন যশোরের চৌগাছার ইমরান হোসেন, মনিরামপুরের আরিফ বিল্লাহসহ অনেকে। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা করে নিয়ে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়েছে চক্রটি।
এভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) শরণাপন্ন হন ভুক্তভোগী রাসেল হোসেনের খালা শেফালি আক্তারসহ আরও কয়েকজন। শেফালি জানিয়েছেন, তার দুই ভাগনেসহ অন্য আত্মীয়দের চাকরির জন্য মোট ৩১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়েছেন প্রতারক চক্রের কাছে। এ অভিযোগ পাওয়ার পরই তদন্তে নামে ডিবি। অবশেষে গত রোববার তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় ঢাকা ও গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে চক্রের হোতাসহ ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবি।
গ্রেফতাররা হলেন- প্রতারক চক্রের মূলহোতা মো. কামরুজ্জামান, তার সহযোগী মো. আবু রায়হান ওরফে রিয়াদ ও মো. নাজির হোসেন। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
যেভাবে প্রতারণা করতেন কামরুজ্জামান
প্রতারক চক্রের মূলহোতা মো. কামরুজ্জামান ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ এলাকায় উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গ্রাফিক্স আর্ট ইনস্টিটিউটে গ্রাফিক্স ডিজাইনে পড়াশোনা করেন। সেই সুবাদে তিনি গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজে খুবই দক্ষ। তার এই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েই তিনি ফটোশপের মাধ্যমে ভুয়া নিয়োগপত্র তৈরি করে চাকরি দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।
নিজেকে কখনো ইঞ্জিনিয়ার, কখনো ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার ভাগিনা বা কখনো রাজনৈতিক কর্মীদের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন জালিয়াতি ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন কামরুজ্জামান। প্রথম দিকে তিনি কয়েকটি কাজ সফলভাবে করেও আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় প্রতারণা করে টাকা আত্মসাৎ করার লোভ তাকে পেয়ে বসে।
পরে তিনি নিজ এলাকার মো. নাজির হোসেনকে তার প্রতারণা চক্রের সঙ্গে যুক্ত করেন। নাজিরকে কামরুজ্জামান শিখিয়ে দেন, তাকে যেন সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ভাগিনা হিসেবে চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
নাজির ঢাকায় একটি হাসপাতালে ওয়ার্ডবয় হিসেবে চাকরি করার সুবাদে তার সহকর্মীদের অনেক আত্মীয়-স্বজনকে প্রতারণার টার্গেট হিসেবে ব্যবহার করেন। পরে তাদের এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হন অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা সদস্যের সন্তান মো. আবু রায়হান ওরফে রিয়াদ। আবু রায়হান সেনা সদস্যের ইউনিফর্ম পরে চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে দেখা করে তাদের চাকরি দেওয়ার বিশ্বাস জন্মানোর কাজটি করতেন।
যেভাবে চক্রের ফাঁদে পা দেন শেফালি
প্রতারক চক্রের নাজির হোসেনের সঙ্গে ২০০৯ সালে শেফালির পরিচয় হয়। শেফালিকে তিনি জানান তার একজন লোক আছেন যিনি টাকার বিনিময়ে চাকরি দিতে পারেন। তখন শেফালি নাজিরকে তার দুই ভাগিনার কথা বলেন। নাজির হোসেন তাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাকরির কথা বলেন।
পরে নাজিরের মাধ্যমে চক্রের কামরুজ্জামান, আবু রায়হান ও মোখলেছুর রহমান মুকুলের পরিচয় হয়। চক্রটি শেফালির ভাগিনা এবং পরে দুই ভাতিজার চাকরির কথা বলে বিভিন্ন ভুয়া নিয়োগপত্র দেখিয়ে কৌশলে ৩১ লাখ ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে শেফালি যাচাই-বাছাই করে জানতে পারেন ওই নিয়োগপত্রগুলো ভুয়া।
প্রতারণার কৌশল
অভিযানসংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তারা জানান, চক্রটি সংঘবদ্ধভাবে প্রতারণা করে থাকে। প্রথমে তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে ভুক্তভোগীর পরিচয় হলে তারা চক্রের আরেকজনকে কোনো দপ্তরের ঊর্ধ্বতন অফিসার বা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতেন। পরে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে চাকরি দেওয়ার চুক্তি করতেন।
বিশ্বাস অর্জনের জন্য কোনো কোনো সময় চক্রের সদস্যরা সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পরে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে দেখা করেন ও চাকরির আশ্বাস দেন। এমনকি চাকরির মেডিকেল টেস্ট করানোর জন্য প্রতারকরা ভুক্তভোগীদের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। এরপর চাকরি হয়েছে বলে ভুয়া নিয়োগপত্র দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেন।
ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (দক্ষিণ) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, চক্রটি অসংখ্য মানুষের সঙ্গে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে প্রতারণা করে টাকা আত্মসাৎ করেছে। এরা চুক্তিবদ্ধ প্রত্যেক চাকরিপ্রত্যাশীর কাছ থেকে ছয়-সাত লাখ টাকা নিয়েছেন। এ টাকা দিয়ে স্থায়ী এবং অস্থায়ী ঠিকানায় জায়গা-জমি, বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করেছেন।
তিনি বলেন, চক্রটির বিরুদ্ধে ডিএমপির সূত্রাপুর থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।