অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, আদায় করে নিতে হয়- মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান
নিউজ ডেস্ক
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। এইজন্য কাজ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক উন্নয়ন হয়েছে, এটা ভাল জায়গা। সরকার এখানে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান নিশ্চিত করতে কাজ করছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
চেয়ারম্যান বলেন, কমিশন গঠন হওয়ার পর আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে গুরুত্ব দিয়ে পুরো টিম এখানে ছুটে এসেছি এই এলাকার মানুষের কথা শুনবো বলে। দেশের অন্য কোথাও আমাদের পুরো টিম যায় না। এখানে এসে যত অভিযোগ, যত সমস্যার কথা শুনেছি, সবকিছু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবগত করবো এবং প্রতিকারের জন্য কাজ করা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে তিনি বদ্ধপরিকর। পার্বত্য চট্টগ্রামে আজকের এই উন্নয়ন সব তার অবদান।
তিনি আরও বলেন, আজকে যেসব অভিযোগ, সমস্যার কথা আমরা শুনেছি আমরা সব নোট করেছি। যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে সেখানে আমরা কাজ করবো।
বুধবার (১৮ জানুয়ারি) সকালে রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গণশুনানীতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
গণশুনানীতে অংশ নেওয়া বিভিন্ন পেশাজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিরা এসময় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্যে না সুবিধা-অসুবিধার কথা তুলে ধরেন।
রাঙামাটি শ্রমিক ইউনিয়ন ও সড়ক ঐক্য পরিষদ নৌযান পরিষদ নেতা পরেশ মজুমদার, বলেন, ‘শ্রমিককে অপহরণ করা হচ্ছে৷ ৪জন শ্রমিককে চাঁদার জন্য অপহরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রত্ন দাশ ও জহির অন্যতম। শ্রমিক অপহরণের সঙ্গে উপজাতি সন্ত্রাসীরা জড়িত। পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত। অত্র অঞ্চলে চাঁদাবাজি ছাড়া কিছু হয়না। সন্ত্রাসীরা চাঁদার জন্য সিএনজি জ্বালিয়ে দিয়েছেন। সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ এখানে প্রশাসন অনেক শ্রম দিয়ে যাচ্ছে এবং কষ্ট করে যাচ্ছে। আমাদের একটা গাড়ি যখন অপহরণ করা হয় তখন আমরা প্রশাসনের সহযোগীতা পায়। কিন্তু সন্ত্রাসীরা যেসব অভিযোগ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে করে তা ডাহা মিথ্যা।’
রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়ার বাসিন্দা শাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির মূল কারণ অবৈধ অস্ত্র। প্রতি জুন মাস আসলে অবৈধ অস্ত্রধারীরা আমাদের থেকে চাঁদা নেয়৷ প্রতিবছর আমরা ৫০০ জন সিএনজি চালক যা আয় করি তা সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিয়ে দিতে হয়। ৪/৫টি সন্ত্রাসী দল রয়েছে৷ তাদের মধ্যে ভালো খারাপ আমরা চিনিনা। কিন্তু তারা সবাই চাঁদাবাজ এটা সবাই জানি। কিছুই দিন আগে বাঙ্গালহালিয়া থেকে আমাদের আপন ছোট ভাইকে অপহরণ করা হয়েছে৷ তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি৷ আমার একটাই দাবি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার চাই।’
রাঙামাটি সরকারী কলেজের ছাত্র পারভেজ মোশাররফ বলেন, ‘বাংলাদেশের ৬১ জেলার মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলে সবার খুশি ও গর্ববোধ করে৷ কিন্তু পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলে একদল তার বিরোধিতা করে। তারা এখানে উন্নয়ন চায়না। কিন্তু আবার উন্নয়ন হলে তা ভোগ করেন! কিছুদিন আগে পূর্ণিমা চাকমাকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে কিন্তু তার বিচার আজো হয়নি৷ আমরা চাই পাহাড়ি-বাঙ্গালী সকলেই মিলেমিশে থাকতে৷ আমরা যখন স্কুল, কলেজে যায় তখন পাহাড়ি মেয়েদের সঙ্গে বাঙালিদের কথা বলতে দেয়না। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা বাধাপ্রদান করে থাকে।’
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শহীদ ইসলাম বলেন, ‘অনগ্রসর জাতি হিসেবে সরকার ১৯৮৪ সালে কোটা সুবিধা চালু করেছে৷ আমরা বাঙ্গালীরা অনগ্রসর হলেও কোটা সুবিধা পাচ্ছি না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপজাতি কোটা রয়েছে কিন্তু বাঙালি কোটা নেই৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড শিক্ষাবৃত্তির মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। ৩০ জনের মধ্যে বাঙালি ২জনও নেই৷ যদি ৩০ জনের মধ্যে ২জনও দেওয়া হতো তাহলে আমরা সন্তুষ্ট রাখতাম। কিন্তু এই বৈষম্যের অবসান কোথায়?’
অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন ও চালক কল্যাণ সমিতির নেতা মিজানুর রহমান বাবু নি বলেন, ‘আমার প্রশ্ন আপনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করেন। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে সবাই মিলেমিশে চলাফেরার চেষ্টা করি। বিগত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ খ্রিঃ আমার অটোরিক্সা শ্রমিক কামাল হোসেন এর সিএনজি অটোরিক্সা কারা জ্বালিয়ে দিয়েছে? রাঙামাটি আসামবস্তি, কাপ্তাই সড়ক, মানিকছড়ি ও কতুকছড়িতে পুলিশ মুভ করতে পারেনা সন্ত্রাসীদের ভয়ে। সেখানে পুলিশ সেনাবাহিনী ছাড়া মুভ করতে পারেনা।৷ এখানে এই সন্ত্রাসীরা কারা? আমরা পহেলা বৈশাখে সম্প্রতি বজায় রেখে করি। আমরা শ্রমিকরা চাঁদার জন্য নির্যাতনের শিকার হচ্ছি। এই থেকে আমরা মুক্তি চায় সেনাবাহিনী ক্যাম্প বৃদ্ধি করা হোক।’
রাজস্থলী উপজেলার বাসিন্দা মোঃ ফোরকান হোসেন মুন্না বলেন, ‘আমার ছোটভাই ২৩ বছর বয়স। বান্দরবান পড়াশোনা করেন। আমার ভাইকে ৪৪দিন আগে জেএসএস অপহরণ করে। আমতলীপাড়া রাজস্থলী হইতে অপহরণ করেছে৷ একটা ছাত্র মানুষকে কেন যে অপহরণ করেছে তা আমার বোধ্যগম নয়। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব জায়গা থেকে হেডম্যান কার্বারী ও জনপ্রতিনিধিসহ সবাই আসছে। সন্ত্রাসীদের এই অত্যাচার কথা সবাই জানে। সবাই জানে আমার ছোটভাই নিরপরাধ এবং আমি বিশ্বাস করি আমার ভাই এখনো অক্ষত আছে৷ আমি প্রশাসনের নিকট জোর দাবি জানায় আমার ভাইকে উদ্ধারের।’
রাঙামাটির বাসিন্দা কাজী জালোয়া বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ঠিকাদারি কাজে চাঁদা দিতে হয়। বিভিন্ন ফলমূল বিক্রি করলে চাঁদা দিতে হয়। আর চাঁদাবাজির বিভিন্ন খাত রয়েছে৷ চাঁদাবাজির অভয়ারণ্য হচ্ছে পার্বত্য জেলাগুলো। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি অনুযায়ী, এখানে ভূমির মালিক তিনজন। যা আইনগতভাবে অসাংবিধানিক এবং বৈষম্য৷ বাজার ফান্ডের জায়গা নিয়ে সমস্যা। বাজার ফান্ড নিয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদ ঝামেলা রয়েছে। তাই ব্যাংক ঋণ বন্ধ রয়েছে। এটার কোন সমাধান নেই! আমরা যখন হেডম্যানের কাছে যায় তখন হেডম্যানকে চাঁদা দিতে হয়। হেডম্যান এর কাছে গেলে বাঙালীরা অর্ধেক মৃত্যু যায়। বাঙ্গালী হয়রানির নাম হেডম্যান। একটি হেডম্যান রিপোর্টের জন্য বাঙালির জুতা ক্ষয় হয়ে যায়।’
রাঙামাটির সাবে মেয়র কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ১৯৭৩ থেকে ৭৭ পর্যন্ত রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র ছিলাম। আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে যা বলতে চাই, আমি অনেক দিন ধরে বলতে চাই আমরা একক আইনের দেশ৷ কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন এর ভিন্নতা? পার্বত্য চুক্তিতে অস্ত্র জমা দেওয়া আমি স্বচোখে দেখেছি। তখন জেএসএস বলেছিল সব অস্ত্র জমা দিবে। কিন্তু চুক্তির এতোবছর পর কেন অবৈধ অস্ত্র? সেসময় যদি ভালোভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে এখন অবৈধ অস্ত্র থাকত না। পার্বত্য চুক্তিতে বলা হয়েছে এখানে ভোটার হইতে হলে এখানে বৈধ জায়গা জমির কাগজপত্র থাকতে হবে! আমি কাপ্তাই বাঁধের পূর্ব থেকে রাঙামাটি ডিসি বাংলো এলাকার বাসিন্দা৷ আমি এখানের সবকিছু জানি৷ এখানে জায়গা না থাকলে ডিসি সনদ বা বাসিন্দা সনদের জন্য মানুষ হয়রানির শিকার হতে হয়। এখানে সংবিধান লঙ্ঘন চলছে৷ ওয়ান ম্যান, ওয়ান ভোট যদি হয়। ২২ বছর ধরে জেলা পরিষদ অর্নিবাচিত প্রতিনিধি চলছে৷ যার কারণে এখানে জনগণের প্রতি প্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতা নেই৷ তারা কেউ জনগণের কথা শুনতে ইচ্ছুক নয়।’
পার্বত্য চট্টগ্রামে নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মজিবর রহমান বাঙ্গালীদের বৈষম্যের বিষয়গুলো উল্লেখ করে ডিসিদের কার্যকারীতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘সার্কেল চীপ ও হেডম্যানকে কর দেওয়ার বিধান সংবিধান পরিপন্থী৷ তিন পার্বত্য জেলার এমপি, মন্ত্রী, জেলা পরিষদ ও উন্নয়ন বোর্ড ও মহিলা এমপিসহ সব পাহাড়ি। বাঙ্গালীরা এখানে কিছু পায়নি৷ শুধু বৈষম্যের শিকার হয়েছে।’
রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নাসরিন ইসলাম বলেন, ‘আমার সদর উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন, চেয়ারম্যান মেম্বার যারা আছেন তারা জানে আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাঁদা দিতে হয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে যখন রাস্তা তৈরি করা হয় তখন সন্ত্রাসীরা ফোন করে ২ লাখ টাকা চাঁদা চায়। কিন্তু যাদের জন্য এই উন্নয়ন তাদেকে যদি চাঁদা দিতে হয় তাহলে তো দুর্ভাগ্য বলে হয় ৷ এখানে যিনি আগে মানবাধিকার সদস্য ছিলেন৷ তিনি কখনো সব প্রতিনিধির সাথে কথা বা সমস্যা জানতে চাননি। পার্বত্য সংরক্ষিত আসনের এমপি বাসন্তি চাকমা শুধুমাত্র কী পাহাড়িদের জন্য এবং খাগড়াছড়ির জন্য? তার শীতবস্ত্র বিতরণ শুধুমাত্র পাহাড়ীদের জন্য! ’
কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামালীগ সভাপতি এবং রাঙামাটি জেলা পরিষদ সদস্য অংসুছাইন চৌধুরী বলেন, ‘আমার এলাকা কাপ্তাই চিৎমরম মানুষ নিজবাড়িতে থাকা দায়। আমি ১৯৮৩ সালে এসএসসি পাশ করি। আমি তখন থেকে আওয়ামালীগ এ যোগদান করি। আমি জেলা পরিষদের সদস্য আমার ভাই এলাকার জনপ্রতিনিধি চেয়ারম্যান। সেই ও আমি বাড়িতে থাকতে পারিনা সন্ত্রাসীদের হুমকির ভয়ে। আমার ইউনিয়ন নেতা হাবিবুর রহমানকে জেএসএস অপহরণ পূর্বক হত্যার চেষ্ঠা করে মৃত্যুভাবে ফেলে চলে যায়। সেদিন সে কোনভাবে বেচে যায়। জেএসএস এর চাঁদাবাজি ও অপহরণের কারণে আমরা শান্তিতে নেই৷ আমরা পাহাড়ি- বাঙালি সম্প্রীতি বজায় রাখতে বিশ্বাসী। আমি মারমা বৌদ্ধ হলেও আমিু মুসলমানদের পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা সময় অংশ গ্রহণ করি। হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিস্টানরা আমাদের সংস্কৃতি ও ধর্মী অনুষ্ঠানে আসে। আমরাও যায়। আমি সরকারি কাজে রাঙামাটি জেলা পরিষদে আসতে প্রশাসনের নিরাপত্তা ছাড়া আসতে পারিনা। আমাকে প্রধানমন্ত্রী চিনেন, আমার স্ত্রীর অসুস্থ থাকার সময় প্রধানমন্ত্রীর নিজে সহযোগী করেছে। আমি চাই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এই কথাগুলো আমি আপনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাতে চাই।’
এছাড়াও পাহাড়ে বসবাসরত একটি গোষ্ঠি চাকরি, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সুবিধা ভোগ করলেও বাঙালি জনগোষ্ঠি সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ সমস্যা নিরসনের দাবি জানান তারা।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে এসময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য মো. আমিনুল ইসলাম, কাওসার আহমেদ, নারায়ণ চন্দ্র সরকার, মো. সেলিম রেজা, কংজরী চৌধুরী, রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী এবং পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এ শুনানীতে অংশ নিয়েছেন।