স্বদেশ ফেরার স্বপ্নে বিভোর ওরা - Southeast Asia Journal

স্বদেশ ফেরার স্বপ্নে বিভোর ওরা

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। তালিকা যাচাই-বাছাইয়ে মিয়ানমারের ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশে আসা এবং কার্যক্রম শুরুর প্রক্রিয়ায় নতুন করে স্বদেশ ফেরার স্বপ্ন দেখছেন আশ্রিত রোহিঙ্গারা।

সচেতন মহল মনে করে, প্রত্যাবাসনের এ প্রক্রিয়ায় যাতে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। অবশ্য এসব ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার।

প্রত্যাবাসন ইস্যুতে রোহিঙ্গাদের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য টেকনাফ বন্দরে আসেন টেকনাফ শালবাগান ২৬ নম্বর ক্যাম্পের সাব-মাঝি ছৈয়দ হোসেনসহ তার ক্যাম্পের অনেক রোহিঙ্গা। একপর্যায়ে ছৈয়দ হোসেন বন্দর থেকে বের হলে কথা হয়।

তিনি বলেন, ‘আমরা স্বদেশে ফিরে যেতে চাই। আশ্রিত জীবনে থাকতে চাই না। কারণ আমাদের নিজেদের দেশ আছে, সেখানে ভিটে-মাটি, জমি-জমা আছে। সেই দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই।’

ছৈয়দ হোসেন আরও বলেন, ‘ক্যাম্পে আশ্রিত জীবন আর বাইরের দেশের ডলার নিয়ে খেয়ে পরে জীবন যাপন করব – এটা কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য নয়। এখন স্বদেশে ফেরা ছাড়া আমাদের বিকল্প নেই।’

শুধু ছৈয়দ হোসেন নন; প্রত্যেক রোহিঙ্গা ফিরতে চান স্বদেশে। আর তালিকা যাচাই-বাছাইয়ে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল আসায় নতুন করে স্বদেশে ফেরার স্বপ্ন দেখছেন তারা।

টেকনাফ শালবাগান ক্যাম্পের বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, ‘মিয়ানমার প্রতিনিধিদল এসেছে খুব খুশি। ৫-৬ বছর হয়েছে, এখন নিজ দেশে ফিরে যেতে বেশি ইচ্ছে হচ্ছে। তাই আমাদের দেশে চলে যেতে চাই।’

আরেক রোহিঙ্গা আনাছ বলেন, ‘সারাজীবন বাংলাদেশে থাকতে পারব না, আমাদের দেশে আমরা চলে যেতে চাই। আমাদের সরকার যদি আমাদের মেনে নেয়; তাহলে আমরা তো অবশ্যই চলে যাব।’

এনাম নামে আরেক রোহিঙ্গা বলেন, ‘এবার যখন মিয়ানমার নিতে এসেছে; আমরা আশা করছি, এবার অবশ্যই মিয়ানমার আমাদের স্বদেশে ফেরাবে।’

ক্যাম্প ২৪-এর বাসিন্দা আমিন উল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার এবার তালবাহানা করবে না – এটা বিশ্বাস হচ্ছে। এবার মিয়ানমার আমাদের নিজ দেশে নিয়ে যাবে আশা দেখছি। আর মিয়ানমার প্রতিনিধিদল আসায় তাদের শুকরিয়া জানাচ্ছি।’

ক্যাম্প ২৭-এর বাসিন্দা আবুল বশর বলেন, ‘প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলাম। তারা আমাদের জন্য অনেক করেছে; শুকরিয়া দিয়ে তা শেষ হবে না। এখন আর ত্রিপলের নিচে বসবাস করতে ভালো লাগছে না। আমাদের দেশ মিয়ানমার যদি এখন দাবিগুলো মেনে নেয়, তাহলে আমরা এখনি নিজ দেশ মিয়ানমারে চলে যাব।’

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি হলেই শুরু হয় ষড়যন্ত্র। তাই ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার পাশাপাশি প্রত্যাবাসনের বিকল্প নেই মনে করছেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা মাহামুদুল হক চৌধুরী।

তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় হয়েছে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এখন দিন দিন রোহিঙ্গাদের সহায়তার পরিমাণ কমছে। তাই এ মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিকল্প নেই। প্রত্যাবাসন ইস্যুতে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল টেকনাফে আসায় সাধুবাদ জানাচ্ছি।

মাহামুদুল হক চৌধুরী আরও বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার কার্যক্রম শুরু হলে কিছু চক্র ষড়যন্ত্র শুরু করে। এতে কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও কিছু এনজিও প্রত্যাবাসন বিরোধী কাজ করে। তাই এদের ব্যাপারে প্রশাসনকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি।

আর অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু-দ্দৌজা জানালেন, এসব ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।

প্রত্যাবাসন ইস্যুতে মিয়ানমার প্রতিনিধি দলটি আগামী কয়েকদিন কয়েক শ রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই-বাছাই করবে। ততদিন পর্যন্ত দলটি টেকনাফে অবস্থান করবে।

ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের জীবনযাপন
উখিয়ার ক্যাম্প-৪-এর রোহিঙ্গা আসমা বলেন, আগে ৫ কেজি চিনি, ৫ কেজি ডাল কিনতে পারতাম। এখন টাকা কমে গেছে, মরিচও কিনতে পারি না। তারপর এখন চাল অন্যজনের কাছ থেকে ধার করে নিতে হবে।

রফিক নামে আরেক রোহিঙ্গা বলেন, ‘মার্চের আগে ১ হাজার ২২০ টাকা করে খাদ্য সহায়তা পেতাম। কিন্তু এখন এক হাজার ২০ টাকার খাদ্য সহায়তা পাচ্ছি। এভাবে খাদ্য সহায়তা কমলে আমরা খুবই কষ্ট পড়ে যাব। কারণ এর আগেও কোনো রকম কষ্ট করে চলতে হতো।’

সিরাজ নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, আগে বাংলাদেশের মানুষসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ এসে সহায়তা করত। তখন ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করতে পেরেছিলাম। কিন্তু ২০১৮ সালের পর থেকে খাদ্য সহায়তা যে কমা শুরু করেছে সেটা আর বাড়ছে না। বিশেষ করে, ২০২৩ সালে খাদ্য সহায়তা আরও বেশি কমে গেছে।

খাদ্য সংকটে বাড়ছে অপরাধ
রোহিঙ্গাদের নিয়ে এমনিতে সবসময় আতঙ্কে থাকেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এখন খাদ্য সহায়তা কমায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও।

উখিয়ার কুতুপালংস্থ রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের খরচের পরিমাণ যখন কমে যাচ্ছে, তখন তারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে তাদের আয়ের উৎস ঠিক রাখতে চাইবে। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর এর বেশি প্রভাব পড়বে বলে মনে করছি।’

উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, বন ও পাহাড় উজাড় হওয়ার পর খাদ্য সংকটের কারণে বন্যহাতির দল লোকালয়ে হানা দেয়। ঠিক তেমনি, রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা যেভাবে কমছে, তাতে রোহিঙ্গারা অল্প কিছুদিনের মধ্যে স্থানীয়দের ওপর হানা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

স্বদেশ প্রত্যাবাসনের দাবি
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ‘রোহিঙ্গারা কোনো দেশছাড়া মানুষ না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী নির্যাতন করে আমাদের দেশছাড়া করেছে। তাই আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করে দ্রুত আমাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন করার দাবি জানাচ্ছি।’

আর শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ পর্যায়ে এসে বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হলে, রোহিঙ্গারা কাজের খোঁজে আরও মরিয়া হয়ে উঠবে। এতে তাদের ক্যাম্পের মধ্যে রাখা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। তবে সরকার রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবাসনের চেষ্টায় রয়েছে। প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা যাতে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে, সেই ব্যবস্থার জন্য সরকার কাজ করছে।

কতটা চাওয়া হচ্ছে, আর কতটা আসছে সহায়তা
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মানবিক সহায়তার জন্য সমন্বয়কারী সংস্থা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) তথ্য অনুযায়ী, মূলত ২০১৯ সাল থেকেই ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অর্থ সহায়তা।
২০১৯ সালে ৯২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়ে পাওয়া গিয়েছিল ৬৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে ১০৫৮ মিলিয়ন ডলার চেয়ে পাওয়া গেছে ৬৮৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে ৯৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়ে পাওয়া গেছে ৬৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আর ২০২২ সালে ৮৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়ে পাওয়া গেছে মাত্র ৫৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

চলতি বছরের শুরু থেকেই কিছু বেসরকারি সংস্থা মানবিক কিছু কর্মসূচি বন্ধ করার বিষয়টি নিজ নিজ কর্মীদের জানিয়েছে। মূলত ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। কিছু প্রকল্পের জন্য দাতাদের অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণেই বন্ধ হচ্ছে কিছু কর্মসূচি, এমনটা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের পর কয়েক মাসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নেন। এর আগে বাংলাদেশে ছিল আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। বর্তমানে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছেন।