খাগড়াছড়ির পাহাড়ি সীমান্তে এক বিজিবি অধিনায়কের ব্যতিক্রমী কার্যক্রম - Southeast Asia Journal

খাগড়াছড়ির পাহাড়ি সীমান্তে এক বিজিবি অধিনায়কের ব্যতিক্রমী কার্যক্রম

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মোঃ সাইফুল ইসলাম, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে

সবুজে ঘেরা পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী যামিনীপাড়া। সীমান্ত সুরক্ষা, অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানো, মালামাল পাচার প্রতিরোধ, মাদক নির্মূলসহ সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ- বিজিবি এর ২৩ ব্যাটালিয়ন। যাবতীয় সীমান্ত সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সম্প্রতি এ ব্যাটালিয়নের আরো কিছু কর্মকান্ড চোখে পড়ছে। স্থানীয় মানুষের মাঝে এ ব্যাটালিয়নের কার্যক্রম নিয়ে তৈরী হয়েছে এক কৌতহলের। প্রায় প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্থানীয় অনলাইন ও জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর পাতায় উঠে আসে ২৩ বিজিবির ব্যতিক্রমী কিছু খবর।

এমন কিছু খবরে নজর রাখার পর ছুটে গিয়েছিলাম মাটিরাঙ্গার যামিনীপাড়ায়। সেখানে গিয়ে তো মোটামুটি আমি বিস্মিত। খবরের পাতার চাইতেও এলাকাবাসীর মাঝে বেশ চাউর হয়ে আছে এ ব্যাটালিয়নের নাম। জোয়ান-বৃদ্ধকে ছাপিয়ে ছোট-ছোট কোমলমতি বাচ্চারাও জানে এখানকার ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের নাম। ২৩ বিজিবির স্টিকার সংবলিত গাড়ি দেখলেই যেন তারা ছুটে যায় গাড়ির সামনে-পেছনে। তাদের মাঝে এবিএম জাহিদুল করিম এক পরিচিত নাম।

এলাকারই মুরুব্বি মমতাজ উদ্দিন জানালেন অবাক এক তথ্য। আগে নাকি এই বিজিবি ব্যাটালিয়নে বহু সিও (অধিনায়ক) এসেছেন আবার চলেও গেছেন। তবে বর্তমান সিও ওই এলাকার মানুষের মাঝে আস্থার অপর নাম। ব্যাটালিয়ন আওতাধীন এলাকায় যে কোন সম্প্রদায়ের, যে কোন ছোট-বড় বিপদে-আপদে সিও সবার আগে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। স্থানীয়রাও বিপদে পড়ে সবার আগে দ্বারস্থ হন ২৩ বিজিবির আরপি গেইটে। এলাকার কোন বাড়িতে কোন নবজাতকের জন্ম হলে কাপড়-চোপড়, খাদ্যসামগ্রীসহ উপহার নিয়ে এগিয়ে যান বিজিবি সদস্যরা।

মমতাজ উদ্দিনের কথাগুলো আমার কাছে কিছুটা বাড়িয়ে বলার মতো মনে হল। যারপরনাই আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে কথা বলার জন্য ঢুকলাম একটি চা দোকানে। সবার মুখেই দেখি এক কথা। ২৩ বিজিবি আর জাহিদুল করিম। এই ২৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের বর্তমান অধিনায়ক লে. কর্নেল এবিএম জাহিদুল করিম।

মৃত ব্যক্তির জানাজা ও দাফনের কার্যক্রমে বিজিবির সহায়তা

খবর নিয়ে জানতে পারি, গত এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখ শনিবার আনুমানিক ০২ ঘটিকায় যামিনীপাড়া ব্যাটালিয়নের অধীনস্থ তবলছড়ি বিওপি’র দায়িত্বপূর্ণ এলাকার তবলছড়ি বাজারে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জনৈক চান মিয়া (৫৫), পিতা-মৃত করিম বেপারী, গ্রাম-পূর্ব রাজারগাঁও, পোস্ট-রাজারগাঁও বাজার, থানা-হাজিগঞ্জ এবং জেলা-চাঁদপুর হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে আকম্মিক মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দীর্ঘ ৭/৮ বছর থেকে তবলছড়ি বাজারে ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। এ এলাকায় তার নিকটাত্নীয় বলতে কেউ না থাকায় তার লাশ নিয়ে বিপাকে পড়ে যান স্থানীয়রা। বিষয়টি জানার পর বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এবিএম জাহিদুল করিম এর নির্দেশনায় একটি টহল দল ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় জনসাধাণের সহায়তায় উক্ত নিঃস্ব ব্যক্তির কাফনের কাপড় ও আনুষঙ্গিক দ্রবাদি ক্রয় পূর্বক জানাযা নামাজ সম্পন্নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। জানাযা নামাজ শেষে জোনের নিজস্ব খরচে এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে মরহুম ব্যক্তির মৃতদেহ তাঁর নিজ বাড়ি চাঁদপুরর প্রেরণ করা হয়।

সম্প্রতি নাকি বিজিবির এই কর্মকর্তা নিজ খরচে ব্যাটালিয়ন আওতাধীন এলাকাগুলোতে হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বিবাহের আয়োজনও করছেন। গতবছরের ৯ সেপ্টেম্বর দুপরে তবলছড়ি গৌরাঙ্গপাড়ার বাসিন্দা হতদরিদ্র মোহন মিয়ার বাড়িতে তার এক মেয়ের বিয়েতে প্রায় দুই শতাধিক বর যাত্রীর খাওয়া থেকে শুরু করে স্বর্ণালংকার ধুমধাম আয়োজন করেন জাহিদুল করিম। বিয়ের অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন ২৩ বিজিবির এই অধিনায়ক।

অসহায় ‍পিতার পাশে দাঁড়িয়ে নিজ খরচে বিবাহের কার্যক্রম সম্পন্ন করেন ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক

গৌরাঙ্গপাড়ার বাসিন্দা হতদরিদ্র মোহন মিয়া ৬ কন্যা সন্তানের জনক। ইতিমধ্যে চার জনের বিয়ে দিয়েছেন। ৫ম বিবাহযোগ্য মেয়ে হালিমা আক্তারের বিয়ের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলেও আর্থিক সংকটে পরে পরিবারটি। এমন খবরে অসহায় এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ান লে. কর্নেল এবিএম জাহিদুল করিম। প্রায় দুই শতাধিক বর যাত্রীর খাওয়া থেকে শুরু করে স্বর্ণালংকার ও নব দম্পতি পরিবারটি স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য উপহার হিসেবে একটি গাভী প্রদান করা হয়।

গতবছরের শেষে আঞ্চলিক উপজাতি সংগঠনের হরতালে এক ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালক ভাড়া নিয়ে রাস্তায় বের হলে তার গতিরোধ করে মারধর ও গাড়িটি পুড়িয়ে দেয় অস্ত্রধারীরা। পরে তার অসহায়ত্বের খবর পেয়ে নিজ খরচে একটি নতুন মোটর সাইকেল কিনে তাকে উপহার দেন বিজিবির এই কর্মকর্তা। এতে করে নতুন করে আবারও আশার আলো জাগে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ওই চালকের মনে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মদিন ও জা‌তীয় শিশু দিবস উপলক্ষে ব্যাটালিয়ন অধিনস্থ এলাকার গৃহহীন ১৭টি পরিবারকে নতুন ঘর উপহার দি‌য়ে‌ছে বিজিবির এই ব্যাটালিয়ন। ১৭টি ঘর তৈরীতে ১১ লাখ ৬৪ হাজার ৫ শত টাকা ব্যয় করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অসহায়ত্বের কথা শুনেও নাকি ছুটে যান বিজিবির এই কর্মকর্তা। ফেসবুকে অসহায়ত্বের ঘটনা শুনে তদন্ত করে অসহায় বেশ কয়েকটি পরিবারকে করে দিয়েছেন বসত ঘর।

পুরো রমজানজুড়ে ২৩ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনস্ত এলাকার অসহায় মানুষজনের পাশাপাশি মসজিদ, এতিমখানায়ও ইফতার সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে মাসব্যাপী। পবিত্র ঈদের ঠিক আগের দিন পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে দুস্থ ও অসহায়দের মাঝে ঈদের উপহার বিতরণ করেন ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক। শুধু তাই নয়, তিনি স্থানীয় ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবগুলোতে উপস্থিত হয়ে তাদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগির পাশাপাশি অনুদান তুলে দিচ্ছেন তাদের হাতে।

কোথাও নবজাতক জন্ম নিলেই উপহার নিয়ে ছুটে যান তিনি

বর্ষার শুরুতে স্থানীয়দের মাঝে স্থানীয়দের মাঝে বিতরণ করা হয় কীটনাশকযুক্ত মশারি। এমনকি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করতে কিছুদিন পরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা করা হয় কুইজ প্রতিযোগিতার। দেয়া হয় আকর্ষনীয় উপহারও।

তীব্র রোদের হাত থেকে বাঁচাতে মৌসুমের শুরুতে শিক্ষার্থীদের মাঝে ছাতাও বিতরণ করেন বিজিবির অধিনায়ক। পরিবেশ রক্ষায় গাছের গুরুত্ব বোঝাতে ছোট-ছোট শিক্ষার্থীদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করে ইতিমধ্যেই বনায়নে ভূমিকা রেখে চলেছেন তিনি।

এলাকার গরীব-অসহায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি ফি থেকে শুরু করে পোষাক ও বই কেনার পুরো খরচও বহন করেন জাহিদুল করিম। অসহায় মহিলাদের জন্য করেছেন সেলাই প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা, প্রশিক্ষন শেষে হাতে তুলে দেন সেলাই মেশিনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম।

হতদরিত্র ও অসহায়দের জন্য চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে ২৩ বিজিবি

নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ২৩ বিজিবির পক্ষ হতে বিভিন্ন দূর্গম এলাকায় পরিচালনা করা হয় বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম। খোদ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক সেখানে উপস্থিত হয়ে সেবা দিয়ে যান পাহাড়ি-বাঙালি দুস্থ ও হতদরিদ্রদের।

সম্প্রতি ফেসবুকে দুই এতিম শিশুর অসহায়ত্বের কথা জানতে পেরে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় অনুদানের ঘোষনা দেন ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক। কারো বাড়িতে ঢেউটিন লাগবে, কারো চিকিৎসা সহায়তা লাগবে, কারো হুইল চেয়ার লাগবে কি না তা ভূক্তভোগী নয় বরং খোঁজ নিয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছেন খোদ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক।

সেদিন ফেসবুকে ছোট্ট একটি ভিডিওতে দেখলাম, ২৩ বিজিবির অধিনায়ক এবিএম জাহিদুল করিম গাড়ি নিয়ে কোথাও যাবার পথে স্থানীয় শিশুরা তার গাড়িটাকে ঘিরে ধরেছে। ভিডিওতে দেখলাম ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক নিজে গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে শিশুদের বিস্কুট, চিপসসহ নানা খাবার দিচ্ছেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, তার গাড়ির পেছনে পুরোটা বিভিন্ন প্রকার খাবারের কার্টুনে ভর্তি।

শিশুদের মাঝে খাবার বিতরণ করছেন ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক
গাড়ি থামিয়ে স্থানীয় মাদ্রাসা ছাত্রদের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করছেন বিজিবি অধিনায়ক

এ বিষয়টি নিয়ে আমার সবচেয়ে বেশী জানার ইচ্ছে ছিল। চলতি পথে হঠাৎ দূর থেকে দেখলাম ২৩ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের গাড়ি রাস্তার এক পাশে দাঁড় করানো। ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক, উনার গাড়ি চালক, রানারসহ বিজিবি সদস্যরা গাড়ির পেছনের দিকে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, লে. কর্ণেল জাহিদুল করিম নিজ হাতে একটি ছোট মেয়েকে জামা ও জুতা পরিয়ে দিচ্ছেন। নিজেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পরে দেখি গাড়ির পেছনে একটি কার্টুন ভর্তি বিভিন্ন সাইজের জামা, পায়জামা ও জুতাসহ নানা সরঞ্জামে ভর্তি। ওই মেয়েটিকে এবং আরেকটি শিশুকে জামা ও জুতা পরানোর পর গাড়ি থেকে তাদের বিস্কুট ও চিপসের প্যাকেট দিলেন। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে সামান্য কিছু টাকাও দিলেন কিছু কিনে খাওয়ার জন্য।

পরক্ষনে আমি বুঝতে পারলাম, স্থানীয়দের কেন এক বিজিবি কর্মকর্তাকে নিয়ে এত প্রশংসা। আসলেই তিনি অতুলনীয়।

স্থানীয়রা বলছেন, সরকারী কর্মকর্তা এমনকি নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও লে. কর্নেল এবিএম জাহিদুল করিম যেভাবে এলাকাবাসীর সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ান তা সত্যিই প্রসংশনীয়। এমন একজন বিজিবি অধিনায়ককে সবসময় এভাবেই পাশে চান স্থানীয় জনসাধারণ।

২৩ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এবিএম জাহিদুল করিম বলছেন, সীমান্তে সুরক্ষার পাশাপাশি সীমান্তে স্থানীয় জনসাধারণের সামাজিক সুরক্ষার যে দায়বদ্ধতা, সেটি কিছুটা হলেও আমাদের ওপরে আসে। তারই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে আমাদের ছোট প্রচেষ্টাগুলো অব্যাহত থাকবে।