ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপের বাণিজ্য করিডর কি চীনকে টেক্কা দেবে? - Southeast Asia Journal

ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপের বাণিজ্য করিডর কি চীনকে টেক্কা দেবে?

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে তখন শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-২০-এর শীর্ষ সম্মেলন চলছিল। সম্মেলনের একফাঁকে তোলা একটি ছবি বিশ্ব গণমাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়। ছবিতে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

ছবিতে তিন নেতা হাসি মুখে পরস্পরের হাত ধরে আছেন। তিন নেতার এই সাক্ষাৎ বেশ গুরুত্ব পায়। কেননা, ওই সময় বিশেষ একটি অর্থনৈতিক করিডরের ঘোষণা দেন মোদি। এই করিডর ভারত থেকে শুরু হয়ে ইউরোপ অবধি যাবে। মাঝখানে যুক্ত করবে মধ্যপ্রাচ্যকে। নাম ‘ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ ইকোনমিক করিডর’ বা আইএমইসি।

এশিয়া ও ইউরোপকে যুক্ত করা এই করিডর শুধু অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নয়, বরং ভূরাজনৈতিকভাবেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মূলত ভারত থেকে শুরু হয়ে ইউরোপ অবধি রেল ও নৌ নেটওয়ার্ক চালুর পরিকল্পনা করেছেন মোদি। তাঁর মতে, এতে পুরো এশিয়া ও ইউরোপ লাভবান হবে। দুই অঞ্চলের মধ্যে সহজে ও কম সময়ে পণ্য পরিবহন করা যাবে। এ ছাড়া শক্তি সম্পদ বিনিময় ও ডিজিটাল যোগাযোগও বহুগুণ বেড়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

মোদির উচ্চাভিলাষী এই প্রকল্প আরেকটি কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, এই করিডরকে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের আলোচিত ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ বা বিআরআই উদ্যোগের বিকল্প ভাবা হচ্ছে। আর এ কারণেই এশিয়া কিংবা ইউরোপের না হয়েও জো বাইডেন মোদির হাতে হাত রেখেছেন।

বিআরআই এমন একটি প্রকল্প, যা চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব ও মধ্য এশিয়া, রাশিয়া এবং ইউরোপকে যুক্ত করছে। এর বিপরীতে মোদির অর্থনৈতিক করিডরে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার বিষয়ে ফরেন পলিসি সাময়িকীর এডিটর-ইন-চিফ রবি আগারওয়াল বলেন, নরেন্দ্র মোদির এই অর্থনৈতিক করিডরের পরিকল্পনা সহজভাবে বলতে গেলে এমন কিছু, যেটা চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন স্বার্থকে আরও বাড়িয়ে দেবে।

সি চিন পিংয়ের বিআরআই উদ্যোগ ঘোষণার এক দশক হয়েছে চলতি বছর। তবে বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, এর মাঝের সময়টায় বিআরআই উদ্যোগের অগ্রগতি অনেকটাই শ্লথ হয়ে এসেছে। এর অন্যতম কারণ, চীনা অর্থনীতির গতি কমে আসায় এ উদ্যোগের বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণের পরিমাণ আগের তুলনায় কমেছে। ইতালির মতো ধনী দেশ বিআরআই উদ্যোগ থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের কথা জানিয়েছে। শ্রীলঙ্কা ও জাম্বিয়ার মতো দেশ বিআরআই উদ্যোগের আওতায় নেওয়া ঋণ পরিশোধে অপারগতার কথা জানিয়েছে।

বিআরআই উদ্যোগ আরও কিছু কারণে বেশ সমালোচিত। এর মধ্য রয়েছে সংযুক্তি প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে চীনের কৌশলগত ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়িয়ে নেওয়ার সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা, দুর্নীতি, স্বচ্ছতার অভাব, স্থানীয়দের চাহিদার প্রতি মনোযোগ না দেওয়া, সার্বভৌমত্বের প্রতি অবহেলা প্রভৃতি। এই মত থিঙ্কট্যাংক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো গিরিশ লুথারার।

‘কানেক্টোগ্রাফি: ম্যাপিং দ্য ফিউচার অব গ্লোবাল’ বইয়ের লেখক পরাগ খান্না বলেন, ‘বিআরআই এত বড় পরিসরে একটি উদ্যোগ যে এর তুলনায় মোদির নতুন অর্থনৈতিক করিডরের পরিকল্পনা বেশ ছোট। তাই এটিকে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী বলাটা ঠিক হবে না। আপনি এর দিকে তাকিয়ে বলতে পারবেন না যে এটার বাস্তবায়ন ছাড়া দুনিয়া অচল হয়ে পড়বে।’

উচ্চাভিলাষী বিআরআই নীতি এগিয়ে নিতে গত জুলাই পর্যন্ত এক ট্রিলিয়নের বেশি ডলার খরচ করে ফেলেছে বেইজিং। ১৫০টির বেশি দেশ এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তাই তো গিরিশ লুথারা বলেন, নরেন্দ্র মোদির এ উদ্যোগ আঞ্চলিকতার সীমানা ছাড়িয়ে একটি বৈশ্বিক উদ্যোগের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপকে সংযুক্ত করার অর্থনৈতিক করিডরের সমঝোতা স্মারক বেশ হালকা। এ ক্ষেত্রে পরবর্তী ৬০ দিনের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত এ উদ্যোগের আওতায় শুধু একটি ভৌগোলিক মানচিত্র বা কোন পথে পণ্য আনা-নেওয়া হবে, সেটা বানানো হয়েছে।

পরাগ খান্না বলেন, ‘এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা বেশ জটিল একটি কাজ। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো কতটুকু বিনিয়োগ করবে, কবে নাগাদ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে, এসব দ্রুত নির্ধারণ করতে হবে।’ এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, এ জন্য নতুন রাজস্ব ও বাণিজ্যকাঠামো তৈরি করতে হবে।

উদাহরণ হিসেবে পরাগ খান্না কাজাখস্তানের মধ্য দিয়ে ট্রান্স-ইউরেশিয়ান রেলওয়ের কথা বলেছেন। এই রেলপথ ৩০টি দেশ অতিক্রম করেছে। তবে এ যাত্রা নিরবচ্ছিন্ন। শুধু যাত্রার শুরুতে ও শেষে ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। কিন্তু মোদির উদ্যোগের ক্ষেত্রে এমনটা বলা হয়নি।

বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপকে সংযুক্ত করার অর্থনৈতিক করিডরে ভূরাজনৈতিক বেশ কিছু জটিলতা বিদ্যমান। যেমন এতে মিসর, ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মতো দেশ সম্পৃক্ত। আঞ্চলিক রাজনীতিতে দেশগুলোর সম্পর্ক খুব একটা উষ্ণ নয়। তাই মিসরের সুয়েজ খালকে এড়িয়ে ভারত থেকে ইউরোপ পর্যন্ত পণ্য পরিবহন কতটা সাশ্রয়ী হবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ স্বামীনাথন আইয়ার টাইমস অব ইন্ডিয়ায় একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ অবধি অর্থনৈতিক করিডরকে সুয়েজ খালের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হবে। কেননা, এখন সুয়েজ খাল হয়ে এশিয়া থেকে ইউরোপে সস্তায় পণ্য পরিবহন হয়ে থাকে। তাই নতুন এ উদ্যোগ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নত করলেও মিসরের সঙ্গে সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে।