রাঙামাটির শুভলং পয়েন্টে আধিপত্য যার, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা তার

রাঙামাটির বরকল উপজেলার শুভলং পয়েন্ট
জামাল উদ্দিন, রাঙামাটি থেকে ফিরে
রাঙামাটির বরকল উপজেলার শুভলং পয়েন্ট। অনেকটা সুয়েজ খালের মতো কাপ্তাই লেকের এক অংশকে আরেক অংশের সঙ্গে যুক্ত করেছে এ পয়েন্ট। এ জলপথ ছাড়া জুরাছড়ি, হাজাছড়া, মাইছছড়িসহ কাপ্তাই লেকের ওই অংশ থেকে রাঙামাটি যেতে হলে শুভলং পয়েন্ট অতিক্রম করতে হয়। এ পথেই বাঁশ, কাঠ, ফলসহ পাহাড়ি অন্যান্য পণ্য রাঙামাটি যায়। এরপর রাঙামাটি থেকে সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায় এসব পণ্য। এসব পণ্য বহনকারী প্রতিটি ট্রলার ও নৌকাকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয় সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে। যে কারণে শুভলং পয়েন্টে আধিপত্য বহাল রাখতে আঞ্চলিক সশস্ত্র গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হয়। এ পয়েন্টে যার আধিপত্য বেশি, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাও তার। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নির্ধারিত হারে সব গ্রুপকেই বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতে হয়।
আঞ্চলিক সশস্ত্র গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষের কারণে প্রায়ই পার্বত্য জেলাগুলোতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ব্যাহত হয় স্থিতিশীলতা ও শান্তি শৃঙ্খলা। ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও পর্যটন ব্যবসাসহ অন্যান্য ব্যবসায় ধস নামে। পাহাড়ে বসবাসকারী শান্তিপ্রিয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালি ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জীবনহানি হয়। সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬ বছরেও পুরোপুরি শান্তি ফিরে আসেনি পাহাড়ি জনপদে।
নিরাপত্তা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, সশস্ত্র গ্রুপগুলোর হানাহানিতে বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন দুই হাজার ৬৪৮ জন। আহত হয়েছেন আরও দুই হাজার ৭২৬ জন। অপহরণ ও নিখোঁজ হয়েছেন তিন হাজার ২১ জন। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি হিসেবে পরিচিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র আগে বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় ২৩৮ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য নিহত হয়েছেন। বাঙালি নিহত হয়েছেন এক হাজার ৫৫ জন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালি আহত হয়েছেন ৮৬৮ জন। অপহৃত ও নিখোঁজ হয়েছেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য ২৭৪ জন ও বাঙালি ৪৬৪ জন। অন্যদিকে চুক্তির পরে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিগত ২৬ বছরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য নিহত হয়েছেন ৯৩৮ জন এবং বাঙালি ৪১৭ জন নিহত হয়েছেন।
একই সময়ে অর্থাৎ ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সশস্ত্র গ্রুপগুলোর অতর্কিত ও চোরাগোপ্তা হামলায় দায়িত্বরত অবস্থায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছেন সর্বমোট ৩৫৪ জন। চুক্তির পর ১৯৯৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৩৫ জন। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য ১৭৬ জন, বিজিবি সদস্য ১১১ জন, পুলিশ সদস্য ৩২ জন, আনসার ও ভিডিপি সদস্য ৭০ জন। এসব বাহিনীর সর্বমোট সদস্য আহত হয়েছেন ৪৭৫ জন। যার মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য ২৫৪ জন, বিজিবি সদস্য ১১৬ জন, পুলিশ সদস্য ৯০ জন এবং আনসার ও ভিডিপি সদস্য ১৫ জন।
স্থানীয়রা জানান, তিন পার্বত্য জেলায় জেএসএস (মূল), জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (মূল) ও ইউডিএফ (ডেমোক্রেটিক)-সহ অন্যান্য উপজাতীয় সংগঠনগুলো নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখতে দেশের জাতীয় রাজনৈতিক দলকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করে। নতুন উপদ্রব কুকি চিন নামে আরেকটি সশস্ত্র গ্রুপ। যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের উপজাতীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে হত্যা, হত্যার হুমকি, নির্যাতন ও অপহরণের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। জীবন বাঁচাতে বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ থেকে চার শতাধিক উপজাতীয় নেতাকর্মী পদত্যাগে বাধ্য হয়েছে। যারা পদত্যাগ করেননি তাদের অনেকে এলাকা ছেড়ে রাঙামাটি শহরসহ বিভিন্নস্থানে আশ্রয় নিয়েছে। মূলধারার জাতীয় রাজনীতি থেকে সাধারণ উপজাতীয়দের বিমুখ করার প্রচেষ্টার বিষয়টি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটি সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন খাতে যে হারে চাঁদা দিতে হয় সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে
প্রতি মাসে শুভলং পয়েন্ট অতিক্রমসহ কাপ্তাই লেক এলাকায় লঞ্চ ও বোট মালিকদের দিতে হয় দুই হাজার টাকা করে। প্রতি নৌকার মাঝিকে দিতে হয় দুই হাজার টাকা। সিএনজিচালিত অটোরিকশাপ্রতি এক হাজার ২০০ টাকা। মুদি দোকানদারকে দিতে হয় ৮০০ টাকা। দোকান মালিক দেন দুই হাজার টাকা। ব্যবসায়ী সমিতি থেকে দেওয়া হয় ২০ হাজার টাকা। মাছ ব্যবসায়ীকে দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। আদা ও হলুদের ব্যবসায়ীদের দিতে হয় দুই হাজার টাকা। গরু ব্যবসায়ীদের দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। সবজি ব্যবসায়ীরা দেন এক হাজার টাকা করে। সেগুনবাগানের মালিকদের দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। ফলের বাগান মালিককে দিতে হয় এক হাজার টাকা। পাড়ার প্রতিটি পরিবারকে ২৫০ টাকা, রেস্টুরেন্ট প্রতি ৩০ হাজার টাকা ও পার্ক বাবদ ২০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। যেখানে যে গ্রুপের আধিপত্য সেখানে তারাই এসব চাঁদার টাকা নিয়ে থাকে।
রাঙামাটি থেকে বের হতে হলে প্রত্যেকটি কাঠ পরিবহনকারী ট্রাককে ১০ হাজার টাকা, বাঁশের ট্রাক দুই হাজার টাকা, কলার ট্রাকপ্রতি এক হাজার টাকা দিতে হয়। অন্যান্য ফলের ট্রাকপ্রতি দিতে হয় দুই হাজার টাকা। ফুলের ঝাড়ুর ট্রাক এক হাজার টাকা, অন্যান্য পণ্যবাহী ট্রাকপ্রতি দুই হাজার টাকা দিতে হয়। নৌকার মাঝিকে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা, চাঁদের গাড়ি প্রতি তিন হাজার টাকা, সিএনজিচালিত অটোরিকশাপ্রতি এক হাজার টাকা, মাহিন্দ্রা পরিবহনপ্রতি এক হাজার টাকা, ইজিবাইক ৫০০ টাকা ও ঠিকাদারদের সেভেন পার্সেন্ট কমিশন দিতে হয়। এছাড়াও বিভিন্ন খাতে চাঁদা দিতে হয় তাদের। প্রতিবছর তিন পার্বত্য জেলায় সশস্ত্র গ্রুপগুলো ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে থাকে বলে তথ্য রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী পার্বত্য এলাকায় সহিংসতা ও হানাহানির বিষয়ে বলেন, রাজনৈতিক দলের একটি উদ্দেশ্য থাকবে। আঞ্চলিক সংগঠনগুলো যে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, তাতে মনে হয় না তাদের ভালো কোনও উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আছে। আমরা দেখছি তারা চাঁদাবাজি, অপহরণের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে সংঘাতেও জড়িয়ে পড়ছে। তারা যদি মানুষের অধিকারের জন্য সংগঠন করে থাকে, তাহলে নিজেদের মধ্যে হানাহানি, মারামারি, অপহরণ ও চাঁদাবাজি কেন করবে? গণতন্ত্রের ওপর হস্তক্ষেপ কেন? যদিও তারা এসব অস্বীকার করে, তাহলে এগুলো কারা করে। তাদের খুঁজে বের করে না কেন ওরা?
এ বিষয়ে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য ও কাপ্তাই আওয়ামী লীগের নেতা অংসুই ছাইন চৌধুরী বলেন, তিনি আওয়ামী লীগ করেন বলে তাকে এলাকা ছেড়ে রাঙামাটিতে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। তার ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছে।
রাঙামাটি জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ বলেন, সারাদেশে সাধারণত যে অপরাধগুলো হয়, পার্বত্য এলাকায় সেই অপরাধগুলো কম। এখানে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই কম। মাদকের কিছু অপরাধ এ এলাকায় হয়। আঞ্চলিক যেসব সংগঠন এখানে রয়েছে সেগুলোর তৎপরতা রয়েছে। তবে বিগত যেকোনও সময়ের তুলনায় এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। গত এক বছরে আঞ্চলিক সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সংঘাতে মাত্র ৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে চারটি। চাঁদাবাজি নিয়ে এখানে বড় অভিযোগ রয়েছে। তবে সব ক্ষেত্রেই পুলিশ তৎপর রয়েছে।