ড. এফ দীপঙ্কর মহাথেরোর মৃত্যুকে হত্যা মামলা হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ আদালতের

ড. এফ দীপঙ্কর মহাথেরোর মৃত্যুকে হত্যা মামলা হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ আদালতের

ড. এফ দীপঙ্কর মহাথেরোর মৃত্যুকে হত্যা মামলা হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ আদালতের
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

বান্দরবানে বহুল আলোচিত বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু ড. এফ দীপঙ্কর মহাথেরোর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় তার ভাইয়ের মামলার আবেদনটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করতে জেলার রোয়াংছড়ি থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) বান্দরবানের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজিএম) আদালত-১ এর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এ এস এম এমরান এই আদেশ দেন।

মামলার অভিযোগে তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন, হ্যাপি চাকমা ও তাঁর স্বামী এমিল তঞ্চঙ্গা এবং জনারণ্য ভিক্ষু। এদের মধ্যে হ্যাপি চাকমা দীপংকর মহাথেরো ভান্তের প্রধান সেবিকা ছিলেন।

বাদী পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ রাশেল বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বৌদ্ধদের ভিক্ষুকূল গৌরব, ধুতাঙ্গসাধক ড. এফ দীপংকর মহাথেরো ধুতাঙ্গ ভান্তেকে রশিতে ঝুঁলিয়ে হত্যার অভিযোগ তুলে আদালতে একটি মামলার আবেদন করা হয়। আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এজাহার হিসেবে লিপিবদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। মামলাটি দায়ের করেন হত্যার শিকার ড. এফ দীপংকর ধুতাঙ্গ ভান্তের ভাই কাজল বড়ুয়া (মহাকশ্যপ ভিক্ষু)।

মামলায় উল্লেখ করা হয়, পরিকল্পিতভাবে ড. এফ দীপংকর ভান্তেকে হত্যা করা হয়েছে। ভান্তের বাম পায়ের হাঁটুতে মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

মামলা সূত্রে জানা যায়, গত ১৩ জুলাই দুপুরে বান্দরবানের কালাঘাটা গোদারপাড় এলাকার আর্যগুহা ধুতাঙ্গ বিমুক্তি বিহারে একটি কুঠিরের লোহার সিলিংয়ের সঙ্গে রশিতে ঝুলন্ত অবস্থায় ড. এফ দীপংকর মহাথেরো ধুতাঙ্গ ভান্তের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহ উদ্ধারের সময় আসামিরা অসংলগ্ন আচরণ করেন। এমনকি মরদেহ উদ্ধারের খবর পেয়ে স্থানীয়রা ও গণমাধ্যমকর্মীরা কুঠিরে ঢুকতে চাইলেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ঘণ্টাখানেক পর পুলিশ আসলে গণমাধ্যমকর্মীদের ঘটনাস্থলে ঢুকতে দেওয়া হয়।

মরদেহ উদ্ধারের পরদিন (১৪ জুলাই) বান্দরবান জেলা হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হয়। পরে মরদেহ তার জন্মস্থান চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ফরাঙ্গীরখীল গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনো মরদেহ ফ্রিজারে সংরক্ষিত আছে।

জানা যায়, ড. এফ দীপংকর মহাথের ফরাঙ্গীরখীল গ্রামের নান্টু বড়ুয়া ও পুটি রাণী বড়ুয়ার ছেলে।

উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক উপজাতি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল ইউপিডিএফ (প্রসীত) ও জেএসএস (সন্তু) কর্তৃক বেশ কয়েকজন বৌদ্ধ ধর্মীয় ভান্তের উপর হামলা, হত্যা, অপহরণ ও বিহার পুড়িয়ে দেয়ার ঘটেছে। ২০২০ সালের ১৬ মে রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম ধুপসিল পাড়া এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু ড. এফ দীপঙ্কর মহাথেরো ভান্তে কর্তৃক নির্মিত আন্তর্জাতিক বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রটিও জেএসএস (সন্তু) কর্তৃক পুড়িয়ে দেবার ঘটনা ঘটে। সেখানে গভীর রাতে জেএসএস এর একদল সশস্ত্র উপজাতি সন্ত্রাসী এসে কোন প্রকার কথা-বার্তা ছাড়াই বৌদ্ধ বিহারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া সেসময় বিহারে থাকা এক সেবককে বেধরক মারধরও করে সন্ত্রাসীরা। ওই ঘটনায় আশে-পাশের আরো কয়েকটি বসতবাড়িও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে জানা যায় সেসময়।

সেসময় স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস দীর্ঘদিন ধরেই ঐ এলাকায় দীপঙ্কর ভান্তের দ্বারা স্থাপনকৃত ভাবনা কেন্দ্রের বিরোধীতা করে আসছিলো। জেএসএস’র বিলাইছড়ি উপজেলা সাধারণ সম্পাদক রাহুল চাকমা দীর্ঘদিন ধরে ওই ভাবনা কেন্দ্র স্খাপন নিয়ে নানা সমালোচনা করেছিলো। তাই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এই ভাবনা কেন্দ্রে আগুন দেয়ার পেছনে জেএসএস’র হাত রয়েছে বলে ধারনা করে এলাকাবাসী। ২০১৮ সালেও জেএসএস (সন্তু) দীপংকর ভান্তে ও তার ভক্তদের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বহুবার হুমকি দিয়েছিলেন। এর আগেও, ফারুয়া এবং নির্মাণ গুহা এলাকায় একইভাবে ভাবনা কেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া হয়, যা ড. দীপঙ্কর ভান্তের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।

ওই ঘটনার পর একই বছরের ১৮ মে বেলা ১২টার দিকে রাঙামাটি প্রেস ক্লাবে ধুপশীল আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ ভাবনা কেন্দ্রের পরিচালনা কমিটির আয়োজনে একটি সংবাদ সম্মেলন থেকে ড. এফ দীপঙ্কর মহাথেরো অভিযোগ করেন যে, বিভিন্ন সময় জেএসএস মূল দলের বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং পাহাড়ি জনসাধারণদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার জন্য নিষেধ করার কারণে, হিংসাত্মক মূলক ভাবে উক্ত ভাবনা কেন্দ্র আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। উক্ত অগ্নিকাণ্ডে থাইল্যান্ড কর্তৃক প্রেরিত অষ্টধাতুর সুবিশাল মূল্যবান বুদ্ধমূর্তিসহ, বুদ্ধবাণী পবিত্র ত্রিপিটক, ভিক্ষুসংঘ, ভাবনাকারিদের নানাবিধি ব্যবহার্য সামগ্রী, আসবাবপত্র সহ আনুমানিক ২ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।

সেদিন ড. এফ দীপঙ্কর থেরো বলেছেন, “আমি যেহেতু মানুষকে বলছি তোমরা জীব হত্যা করো না, মদ গাঁজা খেয়ো না, সন্ত্রাস করো না, জোর জুলুম করোনা, চাঁদাবাজী করো না। কিন্তু সেটা তো তারা মানতে রাজী নয়। তারা বলছে আমরা করবো তাতে তোমার কি? তোমার কারণে তো মানুষ অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। ওদের বক্তব্য হচ্ছে, আমি ওদের সন্ত্রাসী পথের বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছি। আমার কারণে বহু মানুষ ভালো হচ্ছে, শান্তির পথে ফিরে আসছে, এই সন্ত্রাসীদের তা সহ্য হচ্ছে না। তারা চায় চাঁদাবাজী, সন্ত্রাসী, জোর জুলুম হত্যা, মারপিট এসব করে চলবে।”

তিনি সেদিন স্পষ্ট করে বলেন, তাদের গুলিতে আমার সেবক গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমাকে বারবার ওরা মৃত্যুর হুমকি দিচ্ছে। আমি কারো মৃত্যু, ফাঁসি দাবী করতে পারি না। কিন্ত আমি চাই এই সন্ত্রাস বন্ধ হোক। বাংলাদেশ সরকার, পুলিশ ও সেনা প্রশাসনের কাছে আমার আহ্বান জেএসএস সন্ত্রাসীদের এই সন্ত্রাস বন্ধ হোক।

তিনি আরো বলেছিন, সন্ত্রাসীদের কোনো জাতি নেই। কোনো ধর্ম নেই। ওরা মুসলিমও নয়, হিন্দুও নয়, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানও নয়। ওদের একটাই পরিচয় ওরা সন্ত্রাসী। ওদের তো কোনো ধর্ম নেই। ওরা তো টাকা পেলে মা বাবাকেও মেরে ফেলবে। ওদের কাছে কিসের মন্দির, কিসের মসজিদ? তারা তো সন্ত্রাসী। ওরা তো ধর্ম প্রচার করতেই দিচ্ছে না। ধর্ম যেহেতু শান্তির কথা বলে, আর ওরা সন্ত্রাসের কথা বলে। তাই ওরা ধর্ম প্রচারের বিরুদ্ধে। ওরা চায় না মানুষ ধর্ম পথে আসুক। তাহলে ওদের সন্ত্রাস করতে সুবিধা হবে। এফ দীপঙ্কর আরো বলেন, আমি যেহেতু মানুষকে বলছি তোমরা জীব হত্যা করো না, মদ গাঁজা খেয়ো না, সন্ত্রাস করো না, জোর জুলুম করোনা, চাঁদাবাজী করো না। কিন্তু সেটা তো তারা মানতে রাজী নয়। তারা বলছে আমরা করবো তাতে তোমার কি? তোমার কারণে তো মানুষ অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। ওদের বক্তব্য হচ্ছে, আমি ওদের সন্ত্রাসী পথের বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছি। আমার কারণে বহু মানুষ ভালো হচ্ছে, শান্তির পথে ফিরে আসছে, এই সন্ত্রাসীদের তা সহ্য হচ্ছে না। তারা চায় চাঁদাবাজী, সন্ত্রাসী, জোর জুলুম হত্যা, মারপিট এসব করে চলবে। এই শান্তিবাহিনীর সদস্যদের একটাই শ্লোগান ধরো, মারো, কাটো।

ড. এফ দীপঙ্কর ভান্তে সেদিন উপস্থিত সকল সাংবাদিকদের মাধ্যমে, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সেনা প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী এবং সকল সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে উক্ত ঘটনায় জড়িত সংশ্লিষ্ট সকল সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধও করেন।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।