কুকি-চিনের ক্ষত সারাতে বান্দরবানের পর্যটনে চলছে ছাড়ের ছড়াছড়ি

কুকি-চিনের ক্ষত সারাতে বান্দরবানের পর্যটনে চলছে ছাড়ের ছড়াছড়ি

কুকি-চিনের ক্ষত সারাতে বান্দরবানের পর্যটনে চলছে ছাড়ের ছড়াছড়ি
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পর কুকি-চিনের ক্ষত সারাতে বান্দরবানের পর্যটনে চলছে ছাড়ের ছড়াছড়ি। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলার পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

দীর্ঘ ২৯ দিন বন্ধ থাকার পর বৃহস্পতিবার থেকে জেলার ৭ উপজেলার মধ্যে রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলাকে বাদ দিয়ে সদর, লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় পর্যটকদের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। বুধবার জেলা প্রশাসন সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন চার উপজেলায় পর্যটক ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর জেলায় পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সমন্বয় পরিষদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়ে পর্যটকদের ভ্রমণে আসার আহবান জানিয়েছেন।

জেলায় ৯৪টি হোটেল ও রিসোর্ট আছে। এর মধ্যে জেলা সদরে ৭৪টি। বাকিগুলো বিভিন্ন উপজেলায়। জেলার ৮০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত।

বান্দরবান জেলা পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সমন্বয় পরিষদে আহবায়ক নাছিরুল আলম বক্তব্যে বলেন, ‘গত দুই বছরে নানা সময়ে জেলায় পর্যটকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর থেকে অনেক হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন।’

বান্দরবান হোটেল ও রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি সভাপতি মো. গিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি খাবার হোটেল ও রেস্তোরাঁয়ও পর্যটকদের জন্য ১০ শতাংশ ছাড় দেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ছাড়ের মধ্যে রয়েছে আবাসিক হোটেলে ৩৫ শতাংশ, রিসোর্টে ২৫ শতাংশ, খাবার হোটেল ও রেস্তোরাঁয় ১০ শতাংশ, জিপ, কার, মাইক্রোবাসে (চাঁদের গাড়ি) ২০ শতাংশ এবং সিএনজি অটোরিকশা, মাহিন্দ্র (থ্রি-হুইলার) ২০ শতাংশ।

জেলার জনপ্রিয় আবাসিক হোটেল হিল ভিউ হোটেলের সামনে ঢাকা গুলশান এলাকা থেকে ঘুরতে আসা বেশ কয়েকজন পর্যটকের দেখা মেলে। দলনেতা মিঠুন ও সিরাজুল বলেন, ‘বান্দরবান ও আশপাশের এলাকায় বহুবার এসেছি। এবারের উদ্দেশ্যে ছিল থানচি রেমাক্রি, রাজাপাথর ও নাফাকুম যাওয়ার। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুমতি না পাওয়ায় যাওয়া হয়নি।’

মিনহাজ বলেন, ‘বান্দরবানে ভ্রমণের জন্য মূল আকর্ষণ হলো রুমার বগালেক, কেওক্রাডং, তাজিংডং ও থানচির নাফাকুম, আমিয়াকুম, রেমাক্রী জলপ্রপাত, ডিম পাহাড়, তমাতুঙ্গি। সেসব জায়গায় যেতে না পারলে বান্দরবান ঘুরতে আসাটাই বৃথা।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে গত দুই বছরে পর্যটন ও পর্যটক নির্ভর ব্যবসায় আনুমানিক প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি পোষাতে দুই থেকে তিন বছর লাগবে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পিপাসুদের কাছে প্রিয় একটি নাম বান্দরবান। উঁচু-নিচু স্বর্পিল পাহাড়ি পথ, ঝিরি-ঝরনা মিলিয়ে এক অপরূপা পাহাড়ি জনপদ এটি। যেখানে সারা বছর পর্যটকের আনাগোনা থাকে। তবে গত দুই বছরে নিরাপত্তা শঙ্কাসহ নানা কারণে এই অপরূপা জেলায় পর্যটকের আনাগোনা কম ছিল। ২০২৩ সালে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কেএনফের কারণে কয়েক মাস ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ছিল। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে গত ৮–৩১ অক্টোবর পর্যটকদের ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হয়। এই খাতের ব্যবসায়ীরা অপেক্ষার প্রহর গুণেছেন।

গত ৩০ অক্টোবর অংশীজনের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, ৭-১০ দিনের মধ্যে বান্দরবানে পর্যটক ভ্রমণের পথ খুলে দেয়া হবে। জেলা প্রশাসকের এমন আশ্বাসে তখনই পর্যটন সংশ্লিষ্টদের মুখে কিছুটা হাসি ফুটে।

পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বান্দরবান পর্যটনের উপর একের পর এক আঘাতে তাদের মধ্যে হতাশা ভর করে। করোনার আঘাত সেরে উঠতে না উঠতে আসে কুকি-চিনের সমস্যা। এই সংগঠনটির সিংহভাগ সদস্যই বম সম্প্রদায়ের। এই সংগঠনটির পুরো নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। সংক্ষেপে কেএনএফ। আবার এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয় দেশের নতুন জঙ্গী একটি দল। তাদের প্রশিক্ষণ দেয় পাহাড়ের সংগঠনটি। এসবের খড়্গ এসে পড়ে পর্যটনের উপর।
কুকি-চিনের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। সেই ক্ষত না শুকাতেই নেমে আসে আরেক অমানিষা। ৫ আগস্টের পর দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি হয় খাগড়াছড়িতে। এর রেশ রাঙ্গামাটিতে এসে পড়ে। সেখানেও সংঘাত সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা চলে। পাশের দুই জেলায় সংঘাতের ক্ষত বান্দরবানের পর্যটনেও আসে। ফলে গত ৮ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটক ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করে জেলা প্রশাসন। বন্ধ হয়ে যায় পর্যটন স্পটগুলো।

হতাশার কথা শুনিয়েছেন পর্যটন স্পট মেঘলার হলিডে ইন ও নীলাচল সড়কের ইকো সেন্সের স্বত্তাধিকারী জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে কোটি টাকা লোন নিয়ে পর্যটন ব্যবসা করছি। পর্যটনের উপর একের পর এক আঘাত আসায় আমি এখন খেলাপী। দেনার দায় পরিশোধে কূলকিনারা করতে পারছি না।’

তার মতো অনেক তরুণ উদ্যোগক্তা আছেন যারা পথে বসে গেছেন। বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পর্যটনের উদ্যোক্তা হওয়ার দৌড়ে ছিলেন তারা। সেই স্বপ্ন এখন তাদের জীবনে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। সোহেল কান্তি নাথ ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে আরেকজনের কাছ থেকে ভবন ভাড়া করে পর্যটন উদ্যোক্তা হতে চেয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন জীবনের চাকা বদলাতে। সেই স্বপ্ন এখন এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

স্বপ্ন দেখেছিলেন মো. ইসমাইলও। ব্যাংক থেকে সাত লাখ টাকা লোন নিয়ে ১০ লাখ টাকায় কিনে ছিলেন একটি সাদা রঙের চার চাকার মাহেন্দ্র গাড়ি। কেনার কয়েক মাস পর পর্যটনে মন্দা আসে। শেষ পর্যন্ত নতুন কেনা গাড়িটি ছয় লাখ টাকায় বিক্রি করতে হয় তাকে।

এরপরও স্বপ্ন দেখছেন বান্দরবানের পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। আশায় বুক বেঁধে আছেন কখন জমবে পর্যটনকেন্দ্রগুলো।

জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, জেলার সাত উপজেলার মধ্যে রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় পর্যটক ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। প্রথম দিকে বান্দরবান সদর, লামা, আলীকদম নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় পর্যটকরা ভ্রমণ করতে পারবেন। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বসে অন্য তিন উপজেলার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পর্যায়ক্রমে সব উপজেলা খুলে দেওয়া হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনজন রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল ও রিসোর্টের মালিক বলেছেন, পর্যটকরা বান্দরবানে হাতে কম করে হলেও দুইদিন সময় নিয়ে আসেন। প্রথম দিনে নীলগীরি, নীলাচল, স্বর্ণমন্দির, মেঘলা, শৈল প্রপাত ঘুরে দেখা হয়ে যায়। এর পরদিন আর দেখার মতো কোন পর্যটন স্পট থাকে না। পর্যটকদের দেখার মতো আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট রয়েছে থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলাতে। রুমা ও রোয়াংছড়িতে কুকি-চিনের প্রভাব এখনো রয়েছে। ওই দুই উপজেলা বাদ দিয়ে অন্তত থানচি উপজেলার তমাতঙ্গী ও রেমাক্রি পর্যন্ত পর্যটকরা ভ্রমণ করতে পারে। যেহেতু বান্দরবান শহর থেকে থানচি রেমাক্রি ও তমাতঙ্গী সড়ক-নৌপথ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক কিলোমিটার পরপর ক্যাম্প বা চৌকি রয়েছে। সেই হিসেবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কথা নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরো কয়েকজন বলেছেন, বান্দরবান শহর থেকে থানচির রেমাক্রি ও তমাতঙ্গী পর্যন্ত পর্যটকদের ভ্রমণে উৎসাহিত করা যায়। এই এলাকাগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রিত। থানচির রেমাক্রি ও তমাতঙ্গী পর্যন্ত খুলে দিলে পর্যটন ব্যবসায়ীরা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারতেন।

বান্দরবান হোটেল-মোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর থেকে পর্যটন ও পর্যটক নির্ভর ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তাঁরা আশায় আছেন। পর্যটন ও পর্যটক নির্ভর ব্যবসায় গত দুই বছরে আনুমানিক প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এই ক্ষতি পোষাতে দুই থেকে তিন বছর লাগবে।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।