আলী রিয়াজের ‘জাতীয় ঐকমত্য’ ও ইউপিডিএফ: সন্ত্রাসীদের কি রাজনীতির মঞ্চে উঠানো হচ্ছে?

আলী রিয়াজের ‘জাতীয় ঐকমত্য’ ও ইউপিডিএফ: সন্ত্রাসীদের কি রাজনীতির মঞ্চে উঠানো হচ্ছে?

আলী রিয়াজের ‘জাতীয় ঐকমত্য’ ও ইউপিডিএফ: সন্ত্রাসীদের কি রাজনীতির মঞ্চে উঠানো হচ্ছে?
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মোঃ সাইফুল ইসলাম

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে, তা আর কোনও অবস্থাতেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। বিশেষত, আলী রিয়াজের নেতৃত্বে গঠিত ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর সঙ্গে আজ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর আলোচনার পর, পুরো পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। কমিশন কি সত্যিই জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে, না সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক বৈধতা দিয়ে তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ করে দেশের নিরাপত্তা ও শান্তির প্রতি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে?

ইউপিডিএফ, একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে যার শেকড় রয়েছে অত্যাচার, হত্যাকাণ্ড, অপহরণ এবং চাঁদাবাজির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে, সেই দলটিকে এখন রাজনৈতিক দল হিসেবে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। দলটির অন্যতম নেতা মাইকেল চাকমা, যার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে, এখন গণতান্ত্রিক শাসনের কথা বলছেন। কিন্তু প্রশ্ন আসে, কি সত্যিই একজন সন্ত্রাসী নেতা গণতন্ত্রের প্রচারক হতে পারে? তার অতীত তো একেবারেই ভিন্ন ছবি আঁকছে।

এতদিন ধরে ইউপিডিএফ একের পর এক সশস্ত্র সংঘর্ষে অংশ নিয়েছে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় জনগণ, সরকারি বাহিনী এবং সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এসব কাজের পর, তারা এখন ‘গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা’ এবং ‘মানবিক রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছে—এটা কেবল অপসংস্কৃতি না হলে আর কিছু নয়। তাদের দাবির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ইউপিডিএফের ইতিহাসে একমাত্র যা ফুটে ওঠে, তা হল প্রতিরোধের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, যার ফলে অসংখ্য নিরীহ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে। তারা কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করছে, নাকি তাদের নিজস্ব স্বার্থ এবং ক্ষমতার ভিত্তি শক্তিশালী করার জন্য?

কমিশনের বৈঠকে মাইকেল চাকমা দাবি করেন, “ইউপিডিএফ সব সময় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ওপর শ্রদ্ধাশীল”, কিন্তু বাস্তবে তারা কখনোই সেই শাসনের ধারক-বাহক হতে পারেনি। ইউপিডিএফ এবং তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলো শাসন ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে একের পর এক সহিংসতায় মগ্ন ছিল। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষকে খুন, অপহরণ এবং চাঁদাবাজির মতো কর্মকাণ্ডের শিকার বানিয়েছে। এই আলট্রা-জাতীয়তাবাদী দল কখনোই অন্তর্ভুক্তিমূলক বা মানবিক রাষ্ট্রের ধারণা মেনে চলতে পারেনি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হল জনগণের স্বাধীনতা এবং সুরক্ষা, কিন্তু ইউপিডিএফ এবং মাইকেল চাকমা এই মতবাদে বিশ্বাসী নন।

এখানে মাইকেল চাকমার বক্তব্য তুলে ধরার পর, একটি গভীর প্রশ্ন উঠে আসে: এই সমস্ত অপরাধী, সন্ত্রাসী এবং সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত দলের সদস্যদের কি রাজনৈতিক বৈধতা দেওয়া উচিত? মাইকেল চাকমা তাঁর বক্তব্যে দাবি করেছেন যে ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছে। কিন্তু তাদের অতীত এবং বর্তমান কার্যক্রম বলছে কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। তাদের নেতৃত্বে যে আন্দোলনগুলো হয়েছিল, তা দেশের জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে। যেমন, তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের মিছিল, সভা ও কর্মসূচি চালিয়েছিল, যা দেশের বৃহত্তর জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। গত বছরের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সময়েও তারা কোটার পক্ষে অংশগ্রহণ করেছিল, যা সামাজিক অস্থিরতা ও দেশব্যাপী ক্ষতির কারণ হয়েছিল।

আলী রিয়াজের ‘জাতীয় ঐকমত্য’ ও ইউপিডিএফ: সন্ত্রাসীদের কি রাজনীতির মঞ্চে উঠানো হচ্ছে?

আরও দুঃখজনক হলো, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তাতে ইউপিডিএফের ভূমিকা এখনও স্পষ্ট হয়ে উঠেনি। যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে—দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি—তাদের পিছনে মাইকেল চাকমার ইন্ধন থাকার অভিযোগ একেবারেই অগ্রাহ্য করা যায় না। যদি এই ধরনের সহিংসতা সত্যিই তার নেতৃত্বে সংঘটিত হয়ে থাকে, তাহলে তাকে একসাথে মানবিক মর্যাদা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মুখে দাঁড়িয়ে একটি অভ্যন্তরীণ বিপথগামী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। একদিকে তারা ‘গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছে, আর অন্যদিকে তারা এখনও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত—এটি কি এক ধরনের রাজনৈতিক ঠাট্টা নয়? মাইকেল চাকমা এবং তার দল যখন নিজেরাই আইন ভঙ্গকারী, তখন তারা কি করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচারক হতে পারে?

এমনকি আলী রিয়াজ, যিনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি, তিনি কীভাবে এমন সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারেন? তিনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে, ইউপিডিএফের মতো দল আসলেই গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল? মাইকেল চাকমা এবং তার সঙ্গীরা এক সময় রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় লিপ্ত ছিল, যারা সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতি কোনও শ্রদ্ধা দেখায়নি। তারপরও তাদের কীভাবে রাজনৈতিক বৈধতা দেওয়া হচ্ছে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।

মাইকেল চাকমা গণঅভ্যুথান পরবর্তী সময়ে কোন এক গোপন জায়গা থেকে নিজেকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর দায় চাপিয়ে দেশবাসীকৈ আয়না ঘরের কাহিনী শোনালেন। তার এই কাহিনী শুনেই কি আলী রিয়াজ তার প্রতি দূর্বলতা দেখাচ্ছেন?

এমনকি, ইউপিডিএফের সংগঠনের ভেতর যে মারাত্মক ধরনের দমন-পীড়ন এবং সহিংসতা বিদ্যমান, সেটিও মাইকেল চাকমার ভাষণ থেকে একেবারে অদৃশ্য। তিনি যখন বলেন, তারা নিপীড়িত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছে, তখন কি তিনি সেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কথা ভুলে গেছেন, যা তাদের দলের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা আছে?

ইউপিডিএফের রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ অস্বাভাবিক ও মর্মান্তিক। এক সময় এই সংগঠন ছিল সশস্ত্র আঞ্চলিক সন্ত্রাসী দল, যা শুধুমাত্র সশস্ত্র আন্দোলন ও সহিংসতার মাধ্যমে নিজেদের দাবি আদায় করত। আজ যখন তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে, তখন তাদের অতীতের কর্মকাণ্ড যেন একেবারেই ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কীভাবে একটি সশস্ত্র সংগঠন, যা অপহরণ, চাঁদাবাজি এবং খুনের মতো অপরাধে জড়িত ছিল, আজ গণতান্ত্রিক ভাষায় কথা বলছে? তাদের অতীত অপরাধের কোনো দায় কি আজ তারা নিজে বহন করবে না? মাইকেল চাকমা বা ইউপিডিএফের দৃষ্টিভঙ্গি এই গণতন্ত্রের শাসন সম্পর্কে কতটা খোলামেলা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

সবশেষে, এটি পরিষ্কার যে আলী রিয়াজ এবং তার নেতৃত্বাধীন কমিশন যদি সন্ত্রাসীদের রাজনীতির মঞ্চে তুলে আনেন, তবে তা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিপদে ফেলবে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ধারব-বাহক, এক সময়কার সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো যদি আজ দেশে বৈধতা পায়, তাহলে সে রাষ্ট্রে কিভাবে শান্তি এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকবে?

উপসংহারে, প্রশ্নটাই থেকে যায়—আলী রিয়াজের ‘জাতীয় ঐকমত্য’ প্রকৃতপক্ষে কি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতির জন্য, না কি সন্ত্রাসীদের ক্ষমতা গ্রহণের এক নতুন কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? মাইকেল চাকমা এবং ইউপিডিএফের নেতৃত্বের অতীত এবং বর্তমান কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমরা দেখেছি, তাদের রাজনৈতিক আদর্শ কখনোই জনগণের কল্যাণে কাজ করেনি, বরং তাদের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও নিরাপত্তা বিপন্ন হয়েছে। এমন আঞ্চলিক সশস্ত্র দলকে আলী রিয়াজের মতো একজন ব্যক্তি কেন সংলাপে অংশ নিতে উৎসাহিত করছেন? দেশের ইতিহাসে এই ধরনের সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক বৈধতা দেওয়া কি জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে না?

এটি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একত্রীকরণের নাম করে সন্ত্রাসীদের রাজনীতির মঞ্চে আনা, তা কখনোই গণতন্ত্রের পক্ষে উপকারী হবে না। ইউপিডিএফ, মাইকেল চাকমা এবং তাদের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে রাজনৈতিক বৈধতা প্রদান করা, দেশের জন্য একটি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে—এটা নিশ্চিত।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

You may have missed