ইউপিডিএফ কি সন্ত্রাসী সংগঠন নয়?

মোঃ সাইফুল ইসলাম
বাংলাদেশের সরকার সম্প্রতি সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় নতুন করে দল বা সংগঠন নিষিদ্ধের গেজেট জারি করেছে। ২০২৫ সালের ১২ মে তারিখে প্রকাশিত এই গেজেট অনুযায়ী, কোনো দল বা সংগঠন যদি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, সাংবিধানিক শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, সহিংসতা বা সশস্ত্র বিদ্রোহে লিপ্ত হয় কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে—তবে সেই দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যাবে।
এই আইনি কাঠামোর আলোকে এখন সময় এসেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলবার: ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) কি এই সংজ্ঞার বাইরে পড়ে? তারা কি আদৌ একটি রাজনৈতিক দল, নাকি আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠন?
সহিংস রাজনীতি ও চাঁদাবাজির সংস্কৃতি
ইউপিডিএফ ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তাদের কর্মকাণ্ড একটি সংঘবদ্ধ অপরাধচক্রের রূপ নিয়েছে। পাহাড়ি জনপদে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা এবং সন্ত্রাসে ইউপিডিএফের জড়িত থাকার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। পাড়ায়-পাড়ায় “চাঁদা না দিলে গুলি”—এমন বার্তা আজ পাহাড়িদের জীবনের বাস্তবতা।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও রাষ্ট্রদ্রোহ
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় ইউপিডিএফের ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ ভাবে। ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমার প্রত্যক্ষ মদদে বিভিন্ন বাজারে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট তাদের পরিকল্পিত সহিংস রাজনীতির অংশ বলেই পাহাড়ের সচেতন সমাজ মনে করে। এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ভ্রাতৃত্ব ও সহাবস্থানের চর্চা ছিল, তা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শিক্ষার্থী অপহরণ ও পাহাড়বাসীর ক্ষোভ
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে খাগড়াছড়ি অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অপহরণের পেছনে ইউপিডিএফ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে গোয়েন্দা রিপোর্ট ও স্থানীয়দের বক্তব্যে উঠে এসেছে। পাহাড়ি জনগণের মধ্যেও ইউপিডিএফের এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি ইউপিডিএফের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ নিজেরাই রুখে দাঁড়াতে শুরু করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী অপহরণের ঘটনার পর রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-যুব সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ পাহাড়ি নাগরিকরা ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনে অংশ নিচ্ছেন। ‘পাহাড় আমাদের, অপহরণ নয়’, ‘সন্ত্রাস চাই না’—এই ধরনের ব্যানার ও স্লোগানে স্পষ্ট হয়েছে, ইউপিডিএফ এখন আর পাহাড়ের জনগণের প্রতিনিধি নয় বরং জনজীবনের জন্য হুমকি। এই জনআন্দোলন নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বার্তা দিয়েছে—পাহাড়ি জনগণ আর সন্ত্রাসের ছায়ায় বাঁচতে চায় না।
মাইকেল চাকমা: বিচ্ছিন্নতাবাদের মুখপাত্র
ইউপিডিএফের অন্যতম নেতা মাইকেল চাকমা বহু মামলার আসামী। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, নিরাপত্তাবাহিনীকে বিতর্কিত ও বিভ্রান্ত করতে ‘আয়না ঘর’ নাটক সাজিয়ে আত্মগোপন করেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে তিনি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সেফ হাউজে অবস্থান করছিলেন—এমন তথ্যও রয়েছে বিভিন্ন সূত্রের রিপোর্টে। বর্তমানে তিনি পাহাড়ে ফিরে এসে আবারও ভারতের ইন্ধনে উগ্র বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি চাঙ্গা করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। সম্প্রতি তিনি স্বায়ত্তশাসিত পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়ে সরাসরি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
নতুন আইনের আলোকে ইউপিডিএফ
সরকারের সদ্য প্রকাশিত গেজেটে যে সকল অপরাধের কথা বলা হয়েছে—উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সন্ত্রাস, রাষ্ট্রদ্রোহ এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা—সবই ইউপিডিএফের কর্মকাণ্ডের সাথে মিলে যায়। ফলে এই সংগঠনটি “সন্ত্রাসী সংগঠন” হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য আইনি ও বাস্তবিক উভয় দিক থেকেই পরিপূর্ণ যোগ্যতা রাখে।
নিষিদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে পাহাড়ে স্থিতিশীলতা
ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ করা হলে শুধু সহিংসতা ও চাঁদাবাজির পথই বন্ধ হবে না, বরং পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা সহজ হবে। সেইসঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি, মাইকেল চাকমার মতো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের বিচারের মুখোমুখি করা রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ সংগঠনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে আজ পার্বত্য জেলাগুলোতে যে আন্দোলন ও প্রতিবাদের যে ঢল নেমেছে, তা ও নজিরবিহীন। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবানে ইউপিডিএফবিরোধী গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পাহাড় একাত্ম’—এই স্লোগানে আজ পাহাড়ের জনগণ স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে, তারা সশস্ত্র অপহরণ, চাঁদাবাজি, জাতিগত উসকানি ও ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি আর মেনে নেবে না। স্থানীয় জনগণ ও ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে সংঘটিত এই আন্দোলন আরও একবার প্রমাণ করেছে—ইউপিডিএফ এখন জনসমর্থনহীন, জনবিচ্ছিন্ন একটি উগ্র গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়।
রাষ্ট্রের এখন আর সময় নষ্ট করা যাবে না। ইউপিডিএফ সন্ত্রাসী সংগঠন—এই সত্যকে স্বীকার করে, তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সময় এখনই। পাহাড়ের মানুষ শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়, চায় তাদের শিশু যেন অপহরণের শিকার না হয়। একটি সভ্য রাষ্ট্রে এই চাওয়াটা কি খুব বেশি কিছু?
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।