পার্বত্য চট্টগ্রামে র‌্যাবের উপস্থিতি কি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ করবে ? - Southeast Asia Journal

পার্বত্য চট্টগ্রামে র‌্যাবের উপস্থিতি কি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ করবে ?

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

পারভেজ হায়দার

বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলিট ফোর্স র‌্যাবের একটি ব্যাটালিয়ন পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় যোগ দেবার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে নতুন এই ব্যাটালিয়নের জনবল পরিকল্পনা সম্পন্ন হয়েছে। র‌্যাবের আগমনকে ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছে। প্রসীত বিকাশ খীসা’র ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামে র‌্যাব ব্যাটালিয়ন স্থাপনের সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছে। সন্তু লারমার জেএসএস এ বিষয়ে সরাসরি কোন মন্তব্য না করলেও ঐ দলের সাধারণ কর্মীদের মধ্যে এ বিষয়ে অতি সাবধানী মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অপর দু’টি উপজাতিভিত্তিক আঞ্চলিক দল জেএসএস (এম এন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এ বিষয়ে মন্তব্য করতে নারাজ। অন্যদিকে বাঙ্গালী ভিত্তিক আঞ্চলিক দলগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামে র‌্যাবের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে র‌্যাব সৃষ্টির পর থেকে এই বাহিনীর ঈর্ষণীয় সাফল্য রয়েছে; জঙ্গী দমনে এই বাহিনীর তৎপরতা ও সাফল্য চোখে পড়ার মত। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থানগত সামগ্রিক বিষয়াবলী ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের সমরূপ নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে অত্যন্ত সফলতার সাথে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে। র‌্যাবের নতুন এই ব্যাটালিয়নের উপস্থিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাবে কি না, এই বিষয়ে আলোকপাতের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা ধারনা থাকা প্রয়োজন।

ছবি-১: প্রতিকি ছবি, র‌্যাবের সদস্যবৃন্দ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে প্রচলিত কিছু কিছু কথা যেমনঃ “এই এলাকা ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত, তাই চলাচলের সময় সাধারণ জনগনের অতি সাবধানী ভূমিকা অবলম্বন করতে হবে” অথবা “চাঁদা না দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন উন্নয়নমূলক কাজ করা যাবে না” ইত্যাদি কথা এখন নেই বললেই চলে, তবে এটা সত্যি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক উপজাতি দলগুলোর অবৈধ চাঁদা উত্তোলনের হার ব্যাপক হারে হ্রাস পেলেও, এখনও কিছু কিছু খাতে চাঁদা আদান-প্রদান অব্যাহত রয়েছে। সেই সকল ক্ষেত্রগুলোর জন্য আঞ্চলিক উপজাতি দলগুলোর যতটুকু না স্বক্ষমতা রয়েছে, তার চেয়ে চাঁদা প্রদানকারী বড় বড় উৎস যেমনঃ উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো আর বড় বড় কাঠ ব্যবসায়ীগণ বছরের শুরুতেই কিংবা নির্দিষ্ট ঠিকাদারী কাজ পাবার পূর্বে ঐ এলাকায় আপাত দৃষ্টিতে প্রভাব বিস্তারকারী আঞ্চলিক উপজাতি দলগুলোকে চাঁদা প্রদান করে তাদের কাজ শুরু করে থাকে। বিষয়টি যতটা না আঞ্চলিক উপজাতি দলের প্রভাব, তার চেয়ে বেশী এক প্রকার মনস্তাত্তিক ভীতি। যতদুর জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত নিরাপত্তাবাহিনী খুবই সহযোগিতাপূর্ণ। উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারগণ যদি তথ্য দিয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর সহযোগিতা কামনা করতো, তাহলে হয়তো পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উপজাতি দলগুলো অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনে এতগুলো বছর ধরে সফল হতো না। এখানে উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ বড় বড় ঠিকাদারগণই বাঙ্গালি। কিন্তু তারা সাধারণত উপজাতিদের নামে ঠিকাদারী লাইসেন্স ব্যবহার করে দরপত্রে অংশগ্রহন করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিধি অনুসারে উপজাতিদের সকল বিষয় করমুক্ত, তাই উন্নয়নমূলক কাজ শেষে সরকারকে যে পরিমান ট্যাক্স দেয়ার কথা, অধিকাংশ ঠিকাদারগণই অনেকটা সেই পরিমাণ অর্থ আঞ্চলিক উপজাতি দলগুলোকে প্রদান করে। লাভ-লোকসান হিসাব করে এবং সমতল জেলাগুলোর ঠিকাদারদের সাথে তুলনা করে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন না, এই ভাবনা থেকেই মূলতঃ বছরের পর বছর ধরে উপজাতি সন্ত্রাসী দলগুলোর কাছে অবৈধ চাঁদা প্রদান চলমান রেখেছেন তারা।

ছবি-২: সন্তু লারমার জেএসএস’র লোগো।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি আঞ্চলিক চারটি দলগুলোর মধ্যে আন্তঃকলহ ও আন্তঃবিভেদ দৃশ্যমান। সন্তু লারমার জেএসএস আভ্যন্তরীন কোন্দল, স্বার্থানেষী নেতৃত্ব, ক্রমান্বয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়েছে। প্রায়শঃই শোনা যায়, এই দল থেকে হতাশাগ্রস্থ কর্মীগণ পালিয়ে এসে অন্য আঞ্চলিক দলে যোগদান করছে অথবা ঢাকা বা চট্টগ্রামে গিয়ে বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে নতুন কর্মজীবন শুরু করছে। এই দলটি বর্তমানে মূলত বিভিন্ন উপলক্ষ্যকে সামনে রেখে কয়েকটি ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়ার চেষ্টা করছে। তবে দলটি তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় অনেকটা বাধ্য হয়েই বান্দরবানের মার্মা ভিত্তিক উপজাতি দলগুলোর সাথে সমন্বয় করার চেষ্টা করছে বলে জানা যায়।

ছবি-৩: ইউপিডিএফ’র লোগো।

প্রসীত পন্থী ইউপিডিএফও সন্তু লারমার জেএসএস এর মত অনেকটা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। এই দলের বর্তমান দূরবস্থার মূল কারণ, জনবিচ্ছিন্নতা। সাধারণ জনগণ এই দলের নেতাদের স্ব-বিরোধী বক্তব্য ও কার্যক্রম সম্পর্কে আস্তে আস্তে বুঝে ওঠা শুরু করেছে। জেলা ও উপজেলা সদরের বাহিরে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়ে জোর করে তারা সাধারণ জনগণের সহযোগিতা আদায় করতে পারলেও, আস্তে আস্তে ইউপিডিএফ ক্রমান্বয়ে জনগণের গ্রহনযোগ্যতা হারাচ্ছে। সন্তু লারমার জেএসএস দলের ন্যায় এই দল থেকেও প্রতিনিয়ত হতাশাগ্রস্ত কর্মীগণ পালিয়ে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অপর দুটি আঞ্চলিক উপজাতি দল জেএসএস (সংস্কার) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) উভয় দলই ক্রমান্বয়ে সন্ত্রাস পরিহার করে জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে মনোনিবেশ করার বিষয়ে ধীরে ধীরে যত্নবান হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটা কোনঠাসা হয়ে পড়া প্রসীত পন্থী ইউপিডিএফ যখন ঐক্যের ডাক দিয়েছে তখন জেএসএস (সংস্কার) বা ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) কাউকে সাড়া দিতে দেখা যায়নি।

পার্বত্য চুক্তির’ পূর্ব এবং পরবর্তীকালীন উভয় সময়েই নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিঘ্নজনিত বিভিন্ন ঘটনা সংঘটিত হবার পাশাপাশি অধিকাংশ কার্যক্রমের সাথে আদর্শিক এবং জনসাধারণের সহযোগিতা ও সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তাবাহিনী অথবা সশস্ত্র আঞ্চলিক দল উভয় পক্ষের জন্যই সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। উভয় পক্ষের জন্যই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অর্থ হলো, তারা নিজ নিজ সংস্থা বা দলের জন্য ব্যর্থতার অনুঘটক সৃষ্টি করছেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের বাহিরের জেলাগুলোতে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি অব্যাহত থাকলেও বিষয়গুলোতে আদর্শিক ও সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততার অনুপস্থিতি রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে র‌্যাব এর নতুন ব্যাটালিয়ন স্থাপনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছে। র‌্যাব এর নতুন ব্যাটালিয়নের অন্তর্ভূক্তি নিঃসন্দেহে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তাবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুনভাবে আবির্ভূত হওয়া র‌্যাব এর ব্যাটালিয়ন নিশ্চয়ই তাদের কার্যক্রমে এই বিশেষ অঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখবেন, সাধারণ উপজাতি বা বাঙ্গালীদের কাছে গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করবে তাদের কর্মকান্ড। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বছরের পর বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে অত্যন্ত সফলতা অর্জন করেছে। তাদের এই সাফল্যের বিষয়টি অনুধাবন করা যাবে তখনই, যখন পাশ্ববর্তীদেশগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দমনে ঐ দেশ সমূহের নিরাপত্তাবাহিনীর সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাফল্য যদি কখনো তুলনা করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিপূর্ণভাবে সফল; র‌্যাবের আগমন এই সাফল্যের মধ্যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে, এই আশাবাদ সকলের।

পারভেজ হায়দার
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আঞ্চলিক রাজনীতি বিষয়ক গবেষক
ইমেইলঃ parvedgehaider5235@gmail.com