পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ না করার পেছনে লুকায়িত এক ভয়ংকর রহস্য
![]()
-ফেসবুক থেকে নেয়া
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ না করার পেছনে এক ভয়ংকর রহস্য লুকায়িত রয়েছে। এই রহস্য শুধুমাত্র প্রশাসনিক জটিলতা, রাজনৈতিক আপত্তি কিংবা আইনগত ধোঁয়াশার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—বরং এর গভীরে রয়েছে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল, যেখানে ভূমি অনিশ্চয়তা, সন্ত্রাসের আস্তানা এবং বাঙালি-পাহাড়ি বিভক্তিকে ইন্ধন জোগানো হয় সুপরিকল্পিতভাবে।
বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি—এই তিন পার্বত্য জেলায় স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরের বেশি সময়েও কোনো পূর্ণাঙ্গ ভূমি জরিপ হয়নি। অথচ দেশের প্রায় এক-দশমাংশ ভূখণ্ডজুড়ে থাকা এই অঞ্চলটি সরকারি নথিপত্র, দাগ-খতিয়ান ও মৌজা ম্যাপের বাইরে থেকে গেছে বছরের পর বছর। এর ফলে জমির মালিকানা নিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন বিরোধ, মামলা-মোকদ্দমা, সহিংসতা আর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার জন্ম হচ্ছে, যার প্রকৃত সুবিধাভোগী হচ্ছে একশ্রেণির বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সশস্ত্র গোষ্ঠী।
এই বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিকল্পনার মাধ্যমে, যার নেতৃত্বে রয়েছে পার্বত্য জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। এই সংগঠনের প্রধান সন্তু লারমা, যিনি একদিকে শান্তিচুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী, অন্যদিকে চুক্তির ব্যাখ্যার মাধ্যমে সরকারকে বছরের পর বছর আটকে রেখেছেন। পিসিজেএসএস দাবি করে, চুক্তির আগে প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না করে কোনো জরিপ কার্যক্রম চালানো যাবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, চুক্তির সেই শর্ত পূরণে বারবার বাধা সৃষ্টি করছে তারাই। কারণ জরিপ হলে কার হাতে কত জমি আছে, কে প্রকৃত মালিক, কার দখল অবৈধ—এই সত্যগুলো উন্মোচিত হয়ে যাবে, যা দীর্ঘদিন ধরে ‘অদৃশ্য শাসন’ চালিয়ে যাওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা। জরিপ হলেই পাহাড়ের ছায়া-প্রশাসন আর অস্ত্রের জোরে জমি দখলের রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। ফলে ভূমি জরিপ কার্যক্রম শুরু না হবার পেছনে রয়েছে ক্ষমতার রাজনীতি, অস্ত্রভিত্তিক দখলনীতি, বিদেশি এনজিওর সহানুভূতি এবং এক ভয়ংকর জাতিগত বিভাজনের নেপথ্য চক্রান্ত।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, আশির দশকে রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া এলাকায় জরিপ চলাকালে দুই জরিপ কর্মকর্তা অপহৃত হন। তাদের আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর ১৯৮৮ সালের ১২ অক্টোবর সরকার জরিপ কার্যক্রম পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। এরপর প্রায় চার দশকেও জরিপ পুনরায় শুরু করা যায়নি। অথচ ১৯৮৫ সালে সরকার ‘ভূমি খতিয়ান (পার্বত্য চট্টগ্রাম) অধ্যাদেশ’ জারি করে জরিপ কার্যক্রম চালু করার আইনগত ভিত্তি দিয়েছিল। কিন্তু আইন থাকলেও পাহাড়ে আইন চলে না—চলে পিসিজেএসএস, ইউপিডিএফ কিংবা নানা নামে ছদ্মবেশী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হুমকি ও আধিপত্য। ফলে প্রশাসন চুপ, সরকার দ্বিধান্বিত, এবং জনগণ অসহায়। ভূমি নিয়ে বিরোধে শত শত বাঙালি ও পাহাড়ি প্রাণ হারিয়েছে, সহস্রাধিক ঘরবাড়ি পুড়েছে, কেউ হারিয়েছে জমি, কেউ হারিয়েছে নিরাপত্তা, আবার কেউ হারিয়েছে জীবন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, শান্তিচুক্তির পরবর্তী সময়ে ভূমি বিরোধ ঘিরে দুই শতাধিক সহিংস ঘটনা ঘটেছে। বহু মানুষ গৃহহীন হয়েছে, সন্তানহারা হয়েছে মা, স্বামীহারা হয়েছে স্ত্রী। অথচ এর পেছনে প্রকৃত দায়ীদের মুখোশ আজও খুলে ফেলা হয়নি। অনেকের মতে, শান্তিচুক্তির নাম করে যে জমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি বারবার সামনে আনা হয়, সেটি মূলত জরিপকে দীর্ঘমেয়াদে আটকে রাখার একটি রাজনৈতিক কৌশল। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন অনুযায়ী এখানকার ভূমি ব্যবস্থাপনা চলে। কিন্তু ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন কিংবা ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ আইন এখানে কার্যকর নয়। ফলে আইনগতভাবে দেশের অন্য অংশের মতো ভূমির মালিকানা নির্ধারণ করা এখানে সম্ভব নয়, জরিপ না হলে সেই শূন্যতা কোনোদিনই পূরণ হবে না।
একটি স্বাধীন দেশে এমন ‘নো-ম্যান্স ল্যান্ড’ বা আইনবিহীন ভূখণ্ড এক ভয়ংকর নজির। ভূমি জরিপ না হওয়ায় এখানে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে দখলদারিত্বের সংস্কৃতি। একজন নিরীহ বাঙালি কিংবা পাহাড়ি কৃষক তার পূর্বপুরুষের জমিতে চাষ করতে গিয়ে হঠাৎই দেখতে পাচ্ছেন, সেখানে উঠেছে অন্যের বাড়ি, বানানো হয়েছে বাজার, গড়ে তোলা হয়েছে সংগঠনের ক্যাম্প। যারা প্রতিবাদ করছে, তারা হত্যা, লুণ্ঠন বা গুমের শিকার হচ্ছে। অথচ এসব জমির মালিকানা যাচাইয়ের কোনো রেকর্ড না থাকায় আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারছে না ভুক্তভোগীরা। এই সুযোগে গড়ে উঠেছে এক ভয়ংকর ‘সন্ত্রাসী ভূমি অর্থনীতি’—যেখানে জমি কেনাবেচা হয় অস্ত্রের শর্তে, উপজাতিও পরিচয়ের আড়ালে। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি কিংবা জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারাও এ সমস্যার গভীরে ঢুকতে সাহস পান না, কেউ কেউ নীরব সমর্থনও দিয়ে যান তাদের।
সরকার একাধিকবার জানিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে ডিজিটাল সার্ভে চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু মাঠে তার প্রতিফলন নেই। কারণ রাজনৈতিক চাপ, আন্তর্জাতিক সংগঠনের সুপারিশ, এবং এনজিওভিত্তিক মানবাধিকার আন্দোলনের ঢাল ব্যবহার করে ভূমি জরিপকে এক নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ উন্নয়নের নামে যেসব প্রকল্প হচ্ছে, সেগুলোও বিপাকে পড়ছে জমির মালিকানা অজানা থাকায়। স্কুল, সড়ক, হাসপাতাল, কৃষি খামার, বন সংরক্ষণ কিংবা শিল্পপ্রতিষ্ঠান—সবখানেই জায়গা নিয়ে অনিশ্চয়তা। অর্থাৎ জরিপ না হওয়ার পরিণতি শুধুই ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, জাতীয় পর্যায়েও ভয়ংকর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এই ভয়ংকর অবস্থার অবসান ঘটাতে হলে এখনই সময় কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের। সরকারকে রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে সেনাবাহিনীর সহায়তায় সর্বাত্মক ভূমি জরিপ কার্যক্রম শুরু করতে হবে। ডিজিটাল ম্যাপিং, আধুনিক জিপিএস, ড্রোন প্রযুক্তি এবং স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি মৌজা, প্রতিটি খতিয়ান, প্রতিটি জমির দাগ নির্ধারণ করতে হবে। যে জমির বৈধ মালিক নেই, তা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিতে হবে। যাদের জোরপূর্বক জমি দখল করা হয়েছে, তাদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। একইসাথে যারা ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির রাজনীতি করছে, তাদের বিরুদ্ধে চালাতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সুনির্দিষ্ট অভিযান।
একটি রাষ্ট্রে কোনো ভূখণ্ড ভূমি জরিপবিহীন, আইনের বাইরে এবং অস্ত্রধারী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে—এটি জাতির জন্য চরম অপমান ও নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক। ভূমি জরিপ হচ্ছে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ। এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলেই পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে, উন্নয়ন প্রকল্প গতি পাবে এবং বাঙালি-পাহাড়ির সহাবস্থান নিশ্চিত হবে। সুতরাং ভূমি জরিপ না করার পেছনে যে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে, তাকে এখনই প্রতিহত করা না গেলে ভবিষ্যতের পার্বত্য চট্টগ্রাম হবে অশান্তি, দখল, সংঘর্ষ ও আত্মঘাতী রাজনীতির অব্যাহত রণক্ষেত্র।
এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়—নাগরিক সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশাসন এবং গণমাধ্যম—সবাইকে এক হয়ে এই জরুরি কাজটির পক্ষে অবস্থান নিতে হবে।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।