গণমাধ্যম কমিশনের প্রতিবেদনে ‘আদিবাসী’: রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার বিরুদ্ধে উস্কানি
![]()
এ এইচ এম ফারুক
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম- খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান শুধু ভৌগোলিকভাবে নয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একটি সংবেদনশীল অঞ্চল। এই অঞ্চলের ইতিহাস, জনসংখ্যা, প্রশাসনিক কাঠামো এবং জাতিগত বৈচিত্র্য নিয়ে বহু বিতর্ক ও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যা শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রশ্নে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে শব্দচয়ন
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “রাষ্ট্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, উপজাতি, অনগ্রসর ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।” এখানে ‘আদিবাসী’ শব্দের কোনো উল্লেখ নেই।
কীভাবে এবং কখন এলো ‘আদিবাসী’ দাবি
২০০৭ সালে জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার ঘোষণা (টঘউজওচ) গৃহীত হওয়ার পর বাংলাদেশের কিছু এনজিও ও বামপন্থী সংগঠন ‘আদিবাসী’ শব্দের স্বীকৃতি দাবি করতে শুরু করে। এই সময় থেকেই শব্দটি নিয়ে বিতর্ক তীব্র হয়। এর পেছনে সবচে বড় কুশলব বিবেচনা করা হয় রাঙ্গামাটির চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়কে।
দেশের ইতিহাস কী বলে
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনেরপর ১৯৭২ সংবিধান প্রণয়ন এবং এরপর বহুবার সংবিধান সংশোধন, সংযোজন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে কখনোই জাতিগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। বরং সংবিধানের ভাষা ও সংশোধনগুলোতে এই শব্দটি সচেতনভাবে বাদ রাখা হয়েছে, যা রাষ্ট্রের একক পরিচয় ও অখণ্ডতার নীতির প্রতিফলন।
১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে সকল নাগরিককে “বাঙালি” হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। এতে জাতিগত বৈচিত্র্য বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর স্বীকৃতি ছিল না। এই অবস্থানের প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র গণপরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদে ওয়াকআউট করেন। তিনি বলেছিলেন, “এই সংবিধানে আমাদের অস্তিত্ব স্বীকৃত হয়নি।”
পরবর্তীতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” ধারণা প্রবর্তন করেন, যা “বাঙালি জাতীয়তাবাদ”-এর বিপরীতে দাঁড়ায়। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে তিনি অবাঙালি জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তির একটি রাজনৈতিক বার্তা দেন।
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (কথিত শান্তিচুক্তি) এই অঞ্চলের রাজনৈতিক দাবির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি। যদিও চুক্তির কিছু অংশ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তবুও এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় আইন হিসেবে বিবেচিত। চুক্তির কোথাও ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করা হয়নি; বরং ‘উপজাতি’ শব্দটি বিভিন্ন অধ্যায়ে ব্যবহৃত হয়েছে।
২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ২৩(ক) যুক্ত হয়, যেখানে বলা হয়- “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।” এখানেও ‘আদিবাসী’ শব্দটি অনুপস্থিত।
সংসদে প্রত্যাখ্যান এবং আদিবাসী শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা
ওই সময় সংসদে ‘আদিবাসী’ শব্দ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব উঠলেও স্পিকার তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ‘উপজাতি’ শব্দকে সংবিধানসম্মত হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০১৮ সালে তথ্য অধিদপ্তর সাংবাদিকদের উদ্দেশে নির্দেশনা দেয় হয়- “সংবিধান পরিপন্থি ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার বন্ধ করুন।” এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও তথ্য মন্ত্রণালয় একাধিক প্রজ্ঞাপন জারি করে এই শব্দের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে।
এই ধারাবাহিকতা স্পষ্ট করে যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতিতে ‘আদিবাসী’ শব্দের কোনো স্থান নেই। এটি শুধু সাংবিধানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্নে বিভ্রান্তিকর।
ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক বাস্তবতা
নৃতত্ত্ববিদদের মতে, আদিবাসী বলতে বোঝায় এমন জনগোষ্ঠী যারা স্মরণাতীতকাল থেকে কোনো ভূখণ্ডে বসবাস করছে, যাদের উৎপত্তি ও বিস্তারের ইতিহাস নেই। কিন্তু বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠী- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, বম, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া ইত্যাদি জনগোষ্ঠী ১৭৩০ সালের পর থেকে বার্মা, তিব্বত, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মঙ্গোলিয়া ও চীন থেকে বিভিন্ন্ন সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছে এবং পর্যায়ক্রমে স্থায়ী হয়েছে। ফলে তারা আদিবাসী নয়, বরং অভিবাসিত জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত।
চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের লেখক- বীরেন্দ্র লাল চাকমা, উ চা থোয়াই মারমা তাদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, তারা বার্মা ও তিব্বতের সীমান্ত অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। বান্দরবানের বোমাং রাজা হিসেবে পরিচিত সার্কেল চিফও গণমাধ্যমে বলেছেন, “আমরা এদেশের আদিবাসী নই, আমরা এখানে আশ্রয় নিয়েছি।”Online advertising
রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনার ছায়া
‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক তৎপরতা চলছে, তা সুদূরপ্রসারী বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। পূর্ব তিমুর, দক্ষিণ সুদান ও জিবুতির মতো আদিবাসী স্বীকৃতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে আলাদা রাষ্ট্রের দাবি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এই কৌশল অনুসরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামেও আদিবাসী স্বীকৃতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি অর্জন, এবং পরবর্তীতে আলাদা রাষ্ট্রের দাবি তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এই ষড়যন্ত্রে অংশ নিচ্ছেন: কিছু উপজাতি নেতৃবৃন্দ, সমতলের বাম ঘরনার সুশীল সমাজের কিছু অংশ এবং আন্তর্জাতিক এনজিও যারা মানবাধিকার ও সংস্কৃতি রক্ষার নামে রাষ্ট্রবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।
গণমাধ্যম কমিশনের ভূমিকা; দায়িত্বহীনতা না উদ্দেশ্যপ্রণোদিততা?
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়: ১. দায়িত্বহীনতা- যেখানে কমিশন রাষ্ট্রীয় নীতিমালা সম্পর্কে অবগত নয়। ২. সাংগঠনিক পক্ষপাত- যেখানে কমিশনের কিছু সদস্য সচেতনভাবে এই শব্দ ব্যবহার করে একটি রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেয়েছেন।
যে ব্যাখ্যাই হোক, এটি রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সংবিধানের বিরুদ্ধে অবস্থান।
জনমত ও প্রতিবাদ, পাহাড়বাসীর অবস্থান
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা, এই শব্দের ব্যবহারকে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন: ‘আদিবাসী’ নয়, ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ শব্দ ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই, সংবিধান তা স্পষ্ট করেছে। বরং বাঙালিরাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসিন্দা, কারণ তারা বহু শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলে বসবাস করছে। তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন- গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন যদি ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার বন্ধ না করে, তাহলে তিন পার্বত্য জেলা অচল করে দেওয়া হবে।Online advertising
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, শব্দের রাজনীতি ও রাষ্ট্রভঙ্গ
আদিবাসী স্বীকৃতি নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বহুবার রাষ্ট্রভঙ্গের কারণ হয়েছে।
পূর্ব তিমুর: ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে আদিবাসী পরিচয়ের ভিত্তিতে।
দক্ষিণ সুদান: জাতিগত স্বাতন্ত্র্য ও আদিবাসী দাবির মাধ্যমে সুদানের দক্ষিণাংশ আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
জিবুতি: ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে। এই উদাহরণগুলো দেখায়, আদিবাসী শব্দের রাজনৈতিক ব্যবহার কেবল সাংস্কৃতিক নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সীমারেখা পুনর্নিধারণের হাতিয়ার।
সংবিধান ও আইন, সাংঘর্ষিক শব্দচয়ন
বাংলাদেশ সংবিধানের প্রাসঙ্গিক অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- ২৩(ক): আদিবাসী নয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শব্দ ব্যবহারের নির্দেশ। ২৭: আইনের চোখে সকল নাগরিক সমান। ২৮: জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা জন্মস্থানভিত্তিক বৈষম্য নিষিদ্ধ। ২৯: সরকারি চাকরিতে সমান সুযোগের নিশ্চয়তা। ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার এই অনুচ্ছেদগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এবং তা রাষ্ট্রীয় নীতির পরিপন্থী।
শব্দের শুদ্ধতা, রাষ্ট্রের অখণ্ডতা
‘আদিবাসী’ শব্দটি শুধু একটি পরিচয় নয়, এটি একটি রাজনৈতিক অস্ত্র। এই অস্ত্র ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায়, ভূমি অধিকার দাবি, এবং আলাদা রাষ্ট্রের পরিকল্পনা- সবই এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ।
বাংলাদেশের সংবিধান, ইতিহাস এবং বাস্তবতা স্পষ্টভাবে বলে দেয়—পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতি জনগোষ্ঠী আদিবাসী নয়, বরং আশ্রিত ও অভিবাসিত জনগোষ্ঠী। তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার অধিকার আছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় মূলনীতির কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করার অধিকার নেই।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।
উপসংহারে বলা বাহুল্য গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ‘আদিবাসী’ শব্দের পুনরাবৃত্তি শুধু একটি শব্দচয়ন নয়, এটি একটি বার্তা। সেই বার্তা যদি রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে যায়, তবে তা শুধু ভুল নয়- এটি বিপজ্জনকও বটে।
এখনই সময়, এই শব্দের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করে রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করা। ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ শব্দ ব্যবহার করতে হবে, যাতে বিভ্রান্তি না ছড়ায় এবং রাষ্ট্রের অখণ্ডতা প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।
এক বাংলাদেশ, এক সংবিধান, এক পরিচয়- বাংলাদেশী এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
farukkht@yahoo.com