বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতায় ডাঃ বৃষকীর্তির স্বপ্নপূরণ - Southeast Asia Journal

বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতায় ডাঃ বৃষকীর্তির স্বপ্নপূরণ

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

পারভেজ হায়দার

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দৃঢ় নেতৃত্বের গুনাবলী, বিশাল হৃদয় আর মহানুভবতার কারণে সর্বস্তরের মানুষের আকুন্ঠ ভালবাসার প্রতিক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। জন্মশতবার্ষিকীর প্রেক্ষাপটে ‘মুজিববর্ষে’ বিষয়গুলো মানুষের মনে ও আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান দেশ বিভক্তির সময় পূর্ব বাংলা যখন পাকিস্তানের অংশ হয়ে গিয়েছিল, তখন থেকেই সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধু অবতীর্ন হয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের একপেশে আচরণ ক্রমান্বয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণকে সকল ক্ষেত্রে যখন অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলেছিল বঙ্গবন্ধু তখন সবার আশার আলো হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

ছবি-১: ডাঃ বৃষকীর্তি ত্রিপুরা।

বিশাল জনগোষ্ঠীর পূর্ব-পাকিস্তানের সকলের জন্যই এমনকি গ্রাম পর্যায়ের কোনো সাধারণ মানুষও বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা থেকে বঞ্চিত হয়নি। রাঙ্গামাটির বৃষকীর্তি ত্রিপুরা তাদেরই একজন। তার বাবার বাড়ি খাগড়াছড়িতে হলেও লেখাপড়ার প্রয়োজনে সে রাঙ্গামাটিতে তার কাকা সুরেন্দ্র নাথ ত্রিপুরার বাড়িতে থাকতো। সদা হাস্যজ্জল সুদর্শন এই যুবকের চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন, তার বাবা ছেলেকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলেন কিন্তু ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের সামন্ততান্ত্রিক আর স্বৈরতান্ত্রিক বলয়ের প্রভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলো থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ছিল। গুটিকয়েক স্কুল থাকলেও লেখাপড়ার মান তেমন ভাল ছিল না। বৃষকীর্তির প্রানান্ত চেষ্টা আর  বড় হবার স্বপ্ন থাকা সত্ত্বেও পরপর দুইবার মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারেনি সে। দিনে দিনে বৃষকীর্তি আর তার বাবার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়ে চট্টগ্রামে বিএসসি পড়া শুরু করেছিল সে।

ছবি-২: সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন বঙ্গবন্ধু।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাঙ্গামাটিতে পরিদর্শনের জন্য আসেন। সময়টা ছিল বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রথম সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে। বঙ্গবন্ধু রাঙ্গামাটিতে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য ব্যাপক আয়োজন করা হয়। ঐসময় নির্মল চাকমার নেতৃত্বে স্থানীয় উপজাতি যুবকগণ “পাহাড়ী যুব সংঘ” নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিল। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি পাহাড়ী যুব সংঘও বঙ্গবন্ধুর পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরকে সাফল্য মন্ডিত করে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিল। বৃষকীর্তি ও তার পরিবার ছিলো বঙ্গবন্ধুর একান্ত ভক্ত। ঐসময় বৃষকীর্তি যখন জানতে পেরেছিলো বঙ্গবন্ধু রাঙ্গামাটিতে আসবেন, তখনই সে চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটি চলে এসেছিলো। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাতে বৃষকীর্তির পরিবারের প্রানান্ত চেষ্টা ছিলো। সেই সময়ের সুদর্শন যুবক বৃষকীর্তি তার সেরাটাই বঙ্গবন্ধুর জন্য উৎসর্গ করতে চেয়েছিলো। বৃষকীর্তির চাচা সুরেন্দ্র নাথ ত্রিপুরার সাথে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সুসম্পর্ক থাকায় বঙ্গবন্ধুর সম্মানে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার (বৃষকীর্তির) যোগদান করার সুযোগ হয়েছিলো। সেই সুযোগ পেয়ে বৃষকীর্তি নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ঐহিত্যবাহী বোতল নৃত্য পরিবেশন করে উপস্থিত সকল অতিথিদের হৃদয়ে দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু খুব খুশী হয়ে তাকে কাছে ডাকলে সে আবেগে আপ্লুত হয়ে স্বপ্নের ঘোরে আছে মনে করে প্রথমে কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে পড়লেও পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে তাকে প্রনাম করেছিলো। বঙ্গবন্ধুও পরম স্নেহে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন এবং আলিঙ্গন করে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সে ভবিষ্যতে কি হতে চায়? তার স্বপ্নই বা কি? বৃষকীর্তি সরল মনে অকপটে নিজের স্বপ্নের কথা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলো; ডাক্তার হবার বড় স্বপ্ন ছিলো তার। তার বাবাও তাকে ডাক্তার বানানোর জন্য প্রানান্ত চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরপর দুইবার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। যে বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের স্বপ্নের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন সেদিন সেই বঙ্গবন্ধু সহজ-সরল যুবক বৃষকীর্তি ত্রিপুরার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি কি আর নির্লিপ্ত থাকতে পারেন! বঙ্গবন্ধু বৃষকীর্তির মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, তুমি ডাক্তার হবে, তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে।[1] বঙ্গবন্ধু তার কিছুদিন পরে বৃষকীর্তির জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করেন এবং ডাক্তারী পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য তাকে ঐ সময় তিন হাজার টাকা প্রদান করেন।

সময়ের পরিক্রমায় বৃষকীর্তির ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নপূরণ হয়েছিল কিন্তু তার সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতের দুই বছর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু বিপথগামী ব্যক্তিবর্গের হাতে স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু নৃশংসভাবে নিহত হন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সারাদেশের মানুষের মতই বৃষকীর্তির পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। তবে অন্যান্যদের চেয়ে বৃষকীর্তির বাবার আবেগের বহিঃপ্রকাশ সকলের মনে দাগ কেটেছিল। পরপর তিন থেকে চারদিন বৃষকীর্তির বাবার বাড়িতে কোন প্রকার রান্না করা হয়নি, বৃষকীর্তির বাবা কিছুক্ষণ পরপর ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠতেন। গভীর রাতে উঠে সৃষ্টিকর্তার কাছে বঙ্গবন্ধুর জন্য মঙ্গল কামনা করতেন।

বৃষকীর্তি ডাক্তার হওয়ার পর সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে পরিপূর্ণভাবে নিয়োজিত করেছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অবদান রেখেছেন তিনি। খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়াস্থ চম্পাঘাট এলাকায় তার অর্থায়নে একটি অনাথ আশ্রম পরিচালিত হয়, এছাড়া তিনি নিজের খরচে একটি মন্দির নির্মাণ করেছেন।

ছবি-৩: ডাঃ বৃষকীর্তির নিজস্ব অর্থায়নে গড়ে তোলা অনাথ আশ্রম ও মন্দির।

ডাক্তার বৃষকীর্তি ও তার পরিবার মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা না পেলে তার পক্ষে ডাক্তার হওয়া সম্ভব হতো না। ডাক্তার হওয়ার কারণে তার পক্ষে অসংখ্য মানুষকে স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হয়েছে এবং তিনি মানবকল্যাণে অনেক কিছু করতে পেরেছেন। বৃষকীর্তির পরিবার এর পুরো কৃতিত্বই বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে উৎসর্গ করতে চান। শুধু বৃষকীর্তি নয় সারাদেশের মানুষের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতার সুফল ভোগ করতে পেরেছিল। ব্যক্তিপর্যায়ের পাশাপাশি সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর জন্য বঙ্গবন্ধুর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৭৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটিতে দ্বিতীয়বারের মতো সফরকালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।[2]

ছবি-৪: ১৯৭৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলার বাণী সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের অংশ।

এছাড়া ১৪ই জুন ১৯৭৫ সালে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন উপজাতীয় এলাকায় জনগণের জন্য সবকিছু করা হবে।[3]

সেদিনের সুদর্শন যুবক বৃষকীর্তি ত্রিপুরা পরবর্তী জীবনে একজন সফল চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে উন্নীত করতে পেরেছিলেন। বর্তমানে ব্রেন স্ট্রোকের কারণে কিছুটা অসুস্থ হলেও বঙ্গবন্ধুর কথা সব সময় তিনি স্মরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহমাখা সেই সময়গুলো তার চোখের কোনায় উজ্জ্বল হয়ে বারবার ঘুরে ফিরে। বঙ্গবন্ধুর মঙ্গল কামনায় তিনি আশা করেন, বঙ্গবন্ধু যেখানেই আছেন, যেন ভালো থাকেন।

 

 

 

 

[1] ডাঃ বৃষকীর্তির সাথে স্বাক্ষাৎকারের ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করুন-

[2] দৈনিক বাংলার বানী, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৫।

[3] দৈনিক পূর্বদেশ, ৭ই জুন, ১৯৭৩।