কিশোর চাকমার আলো ছড়ানোর গল্প - Southeast Asia Journal

কিশোর চাকমার আলো ছড়ানোর গল্প

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মোঃ সাইফুল ইসলাম

সাধারন মানুষের অসাধারন হয়ে ওঠার পথের বাঁকে থাকে ছোট ছোট অনেক গল্প। যে গল্প বিশ্বাসের, যে গল্প পরিশ্রমের, যে গল্প ধৈর্য্য ধারনের, যে গল্প সাহসীকতার। ঘুরে দাড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় পথচলা। নানা বাঁধা আসে চলার পথে। ঝুঁকি সামলে নিতে না নিতে আবার ঝুঁকি আসে। পথচলতে গিয়ে থেমে যাওয়া মানে তো সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়। আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে আবার উঠে দাড়াতে হয়। সাফল্য তাদের কাছেই ধরা দেয় যারা থেমে গিয়েও পথের শেষ দেখতে এগিয়ে যায়। তেমনিই একজন খাগড়াছড়ির অদম্য যুবক কিশোর চাকমা (৩১)।

খাগড়াছড়ির জেলা সদরের কমলছড়ি ইউনিয়নের বেতছড়িমুখ এলাকার বাসিন্দা কিশোর চাকমার নামটাই এখন বড় পরিচয়। নিজের স্বপ্ন ভেঙে গেলেও যে কিনা নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে স্থানীয় অন্য প্রতিবন্ধীদের। হাল ধরেছেন অন্যদের জীবনকে নতুন করে সাঁজাবার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন ছিলো তার, পড়াশোনার পাঠ শেষে চাকরি করে সংসারের হাল ধরার ইচ্ছে ছিলো কিশোর চাকমার। সবকিছু ঠিকঠাক পথে চললেও হঠাৎ একটি দুর্ঘটনা সবকিছু এলোমেলো করে জীবনের বাঁক ঘুরিয়ে দেয়। হঠাৎ করে কিশোরের জীবন চলা শুরু হয় হুইল চেয়ারে বসে, তবে নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে না পারলেও নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে এখন অন্যের স্বপ্ন বুনছে তিনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, খাগড়াছড়ির জেলা সদরের কমলছড়ি ইউনিয়নের বেতছড়িমুখ এলাকার কৃষক মিলন কান্তি চাকমার ছেলে কিশোর চাকমা। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। স্থানীয় স্কুল ও কলেজে এসএসসি ও এইচএসসি শেষে ভর্তি হন গাজীপুর কালিয়াকৈর ডিগ্রি কলেজে। ২০০৯ সালে কলেজটিতে অনার্স প্রথম বর্ষে তিনি অধ্যায়নরত ছিল সে। পাশাপাশি আবাসিক সুবিধা থাকায় গাজীপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ অ্যাডভেন্টিস সেমিনারি অ্যান্ড কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হন। সে বছরের সেপ্টেম্বর মাসে হোস্টেলের তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে মেরুদণ্ডে আঘাত পান কিশোর। পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ভারতে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকলেও কোনো উন্নতি হয়নি। দুর্ঘটনার পর থেকে সাভারের পঙ্গু হাসপাতালে টানা দুই বছর চিকিৎসাধীন ছিলেন। ততদিনে তিনি সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে কম্পিউটার শিক্ষা রপ্ত করে ফেলেছিলেন। শিক্ষকরা তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করার কথা বললেও ততদিনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। ২০১২ সালে ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে। নিজের বর্তমান অবস্থা ও নিজের মতো অন্যদের কথা চিন্তা করে তার মত শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য কিছু করার তাড়না থেকে গড়ে তোলেন ‘স্বপ্ন প্রতিবন্ধী সংগঠন ও ট্রেনিং সেন্টার’। যেখানে বিনামূল্যে সেলাই ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পাশাপাশি পারিবারিকভাবে অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধীদের নিজ ঘরে রেখে পড়াশোনা করাচ্ছেন তিনি। কিশোর চাকমার এমন উদ্যোগ অনুকরণীয় বলছেন স্থানীয়রা।

কিশোর চাকমার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পর আমার সবকিছু হুইল চেয়ার কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আমি কিছুই করতে পারতামনা। তখন নিজের অক্ষমতা দেখে ভাবলাম আমার মত শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু একটা করি। বাড়ি ফেরার কিছুদিন পর এলাকার গরিব, এতিম, প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে পড়ানো শুরু করি। এখন পর্যন্ত ৫০ জনকে টানা পড়িয়েছি। যাদের অনেকে এখন অনার্সে পড়ছে, কেউবা এসএসসি বা অষ্টম শ্রেণীতে। পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তাদের সচেতন করতাম।

সমতলের প্রতিবন্ধীদের তুলনায় পাহাড়ের প্রতিবন্ধীরা অনেক অসচেতন জানিয়ে তিনি বলেন, একটা পর্যায়ে এসে ভাবলাম প্রতিবন্ধীদের জন্য স্থায়ী কিছু একটা করি। সেই চিন্তা থেকে ২০১৮ সালে গড়ে তুলি ‘স্বপ্ন প্রতিবন্ধী সংগঠন ও ট্রেনিং সেন্টার’। সে সময় ১৫ জন প্রতিবন্ধী নিয়ে যাত্রা শুরু করি। তাদের বিনামূল্যে সেলাই ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেই। প্রতিবন্ধী ছাড়াও স্থানীয়রাও এখন আমার এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। বর্তমানে কম্পিউটার এবং সেলাইয়ে মোট ৩১ জন প্রশিক্ষণার্থী রয়েছেন। এছাড়া দুইজনকে নিজের ঘরে রেখে পড়াশোনা করাচ্ছেন। মূলত কম্পিউটারের কাজ এবং পরিবার থেকে কিছু নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চলছে বলে যোগ করেন তিনি।

১২ থেকে ২৪ ফিটের জরাজীর্ণ একটি বেড়ার ঘর। ঘরটির অর্ধেক জায়গাজুড়ে ছয়টা সেলাই মেশিন এবং দুইটি কম্পিউটার। সেখানে প্রতিবন্ধীদের কেউ কম্পিউটার শিখছে কেউবা সেলাই প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। শুধু কী প্রতিবন্ধী? নাহ। স্থানীয় ছেলেমেয়েরাও পড়াশোনার ফাঁকে বিনামূল্যে এ প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘স্বপ্ন প্রতিবন্ধী সংগঠন এবং ট্রেনিং সেন্টার’। আর ঘরটির অর্ধেক জায়গায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন সংগঠনটির স্বপ্নদ্রষ্টা প্রতিবন্ধী কিশোর চাকমা (৩১)।

এখনো পরিবারের ভার বাবা-বোনের ওপর। তবে, প্রতিবন্ধীদের জন্য এমন উদ্যোগে পরিবার থেকে এখন খুব একটা সহযোগিতায় পায় না কিশোর। কিশোর জানায়, আমার বাবাও হার্টের রোগী। এখন আগের মতো কাজ করতে পারেন না। চাষবাস করে সংসার চলে। বোনরাও কিছুটা সহযোগিতা করে। এমন পরিস্থিতিতে আমার এমন কাজে সহযোগিতা না পাওয়াটা স্বাভাবিক। স্ত্রী চঙ্কি চাকমা ও দেড় বছর বয়সী ছেলে আর্য চাকমা নিয়ে কিশোরের সংসার। নিজের সংসার নিয়ে আপাতত খুব একটা ভাবছেন না কিশোর। ভাবনায় জায়গা নিয়েছে সংগঠনটি।

কিশোর চাকমা বলেন, আমি দীর্ঘ ১০ বছরে কোনো ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাইনি। এমনকি আমার এখানে আসা অনেকের প্রতিবন্ধী কার্ড থাকলেও ভাতা মিলছে না। প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানান তিনি। পাশাপাশি ‘স্বপ্ন প্রতিবন্ধী সংগঠন ও ট্রেনিং সেন্টার’এ সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।


শারীরিক প্রতিবন্ধী দীপংকর চাকমা ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী অরুণ দেওয়ান কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তারা বলেন, আমরা এখানে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। পুরোপুরি রপ্ত করতে পারলে নিজ এলাকায় কম্পিউটারের দোকান দেওয়ার ইচ্ছে আছে। যেখানে প্রিন্ট, কম্পোজ, গান লোড করতে পারবো।

প্রতিষ্ঠানটিতে এখন পর্যন্ত প্রাপ্তি বলতে তিনটি সেলাই মেশিন। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান মোঃ শানে আলম সেলাই মেশিনগুলো দেন। এদিকে সংগঠনটিতে বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন উমাচিং মারমা ও প্রজ্ঞা তালুকদার। কথা হয় উমাচিং মারমার সঙ্গে। তিনি বলেন, কিশোর প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। এমন উদ্যোগে তার পাশে থাকা দরকার। যেহেতু আমি সেলাই কাজ জানি তাই ভাবলাম এখানে প্রতিবন্ধীসহ অন্যদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেই।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা মোহাম্মদ; শাহজাহান কিশোর চাকমার এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, সরকারের পাশাপাশি এমন ব্যক্তি উদ্যোগ সমাজের জন্য দৃষ্টান্ত। আমাদের পক্ষ থেকে সংগঠনটির জন্য যতটুকু পারি সহযোগিতা করবো।

পরিবার, সংসার, সংগঠন। সবকিছু মিলে হতাশা থাকলেও কিশোর আশাবদী। তার ‘স্বপ্ন প্রতিবন্ধী সংগঠন ও ট্রেনিং সেন্টারের পাশে যদি সরকার দাঁড়ায় জেলাতে প্রতিবন্ধীদের আলোর দিশারী হতে পারে এই প্রতিষ্ঠান।