বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
 
                 
রুপা মল্লিক রুপু
মধুমতি আর ঘাগোর নদীর তীরে হাওড়-বাওড়ের মিলনে গড়ে ওঠা গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। তৎকালীন জেলার নাম ছিলো ফরিদপুর, আজকের গোপালগঞ্জ। গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে সারি সারি গাছগুলো ছিল ছবির মতো সাজানো। নদীতে তখন বড় বড় পালতোলা পানশি, কেরায়া নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার চলতো। বর্ষায় গ্রামটিকে মনে হতো যেন শিল্পীর আঁকা জলে ডোবা একখন্ড ছবি। এই টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বনেদী শেখ পরিবারেই জন্ম হয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, বাঙ্গালী জাতির জনক ও বিশ্ব নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।

বিশ্বনেতার শৈশবঃ
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। এদিন শেখ লুৎফর রহমান ও তার সহধর্মিনী সায়রা খাতুনের ঘরে জন্ম নিলো একটি ফুটফুটে শিশু। বাবা-মা আদর করে নাম রাখলেন খোকা। এই খোকাই হলেন বাঙ্গালী জাতির পথ নির্দেশক, অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি এখন জগৎ স্বীকৃত বিশ্ব নেতা। তিনি ছিলেন একজন মাতৃভক্ত সন্তান। শৈশব-কৈশোরে বাবা-মা তাকে আদর করে খোকা বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাদের তৃতীয় সন্তান। স্বভাবের দিক দিয়ে ছিলেন একটু জেদি, চঞ্চল ও একগুঁয়ে। বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমামন্ডিত টুঙ্গিপাড়াতেই। সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামলা রূপসী বাংলার আবহমান বাংলার আলো-বাতাসে লালিত ও বর্ধিত হয়েছেন বিশ্বনেতা।
শৈশবে মুজিব দোয়েল ও বাবুই পাখি ভীষণ ভালোবাসতেন। বাড়িতে শালিক ও ময়না পুষতেন। আবার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতেন। বোনদের নিয়ে বানর, কুকুরও পুষতেন । পাখি ও জীবজন্তুর প্রতি ছিল গভীর মমতা। খালের পাড়ে বসে বসে মাছরাঙা ডুব দিয়ে কীভাবে মাছ ধরে, তাও তিনি খেয়াল করতেন । ফুটবল ছিল তার প্রিয় খেলা। এভাবে তার শৈশব কেটেছে মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে আর বর্ষার কাদা পানিতে ভিজে। গ্রামের মাটি আর মানুষ তাকে প্রবলভাবে আর্কষণ করতো। তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন।
বিশ্বনেতার শিক্ষাজীবনঃ
বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান আদালতে চাকরি করতেন । তার মাতা সায়েরা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে তিনি একজন বিজ্ঞ আইনজীবী হবেন। টুঙ্গিপাড়ার সেই শেখ বাড়ির দক্ষিণে ছিল কাছারি ঘর। এখানেই মাস্টার ও মৌলভী সাহেবদের কাছে ছোট্ট মুজিবের হাতেখড়ি। একটু বড় হলে তাদের পূর্ব পুরুষদের গড়া গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার লেখাপড়া শুরু হয়। এরপর পিতার কর্মস্থল মাদারীপুরের ইসলামিয়া হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে তার পিতা বদলি হয়ে গোপালগঞ্জে যোগদান করলে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। বিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন তিনি। পছন্দ করতেন ইতিহাসের বই। এসব কারণে প্রধান শিক্ষক গিরিশ চন্দ্রসহ সকল শিক্ষকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিব। শিশুকাল থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন পরোপকারী এবং অন্যায়ের প্রতিবাদী। মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় যেমন সহযোগিতার হাত বাড়াতেন-তেমনি কারো প্রতি অন্যায় আচরণ দেখলে প্রতিবাদ করতেন। মাত্র তের বছর বয়সে প্রতিবাদের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন মুজিব। তাঁর বয়স যখন চৌদ্দ, তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি হঠাৎ চক্ষুরোগে আক্রান্ত হন। অনেক চিকিৎসা চলে। কিন্তু অসুখ সারে না। এ কারণে তাঁর লেখাপড়া সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। তিন বছর পর আবার সুস্থ হয়ে তিনি অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। মনোযোগী হন লেখাপড়ায়। তখন ঘটে আরেক ঘটনা। গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল পরিদর্শনে আসেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর ব্যাপারে শহরের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। বিষয়টি কিশোর মুজিবের ভাল লাগেনি। তাই তিনি আয়োজকদের একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন এবং দুর্জয় সাহস নিয়ে একটি মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করেন।
শৈশব থেকেই তিনি খুব অধিকার সচেতন ছিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয়কর্মী হামিদ মাস্টার ছিলেন তার গৃহ শিক্ষক। তার এক স্যার তখন গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য একটি সংগঠন করেছিলেন। শেখ মুজিব ছিলেন এই সংগঠনের প্রধান কর্মী। বাড়ি বাড়ি ধান চাল সংগ্রহ করে ছাত্রদের সাহায্য করতেন। তিনি ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন। স্কুল টিমের নেতা হয়ে বেশ কয়েকবার জিতে যায় তার দল। শৈশব থেকেই তিনি তৎকালীন সমাজ জীবনের জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজা নিপীড়ন দেখেছেন। গ্রামের হিন্দু মুসলমানদের সম্মিলিত সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসম্প্রদায়িকতার। আর পড়শি দরিদ্র মানুষের দুঃখ, কষ্ট তাকে সারাজীবন সাধারণ দুঃখী মানুষের প্রতি ভালবাসায় সিক্ত করে তোলে। বস্তুতপক্ষে সমাজ ও পরিবেশ তাকে অন্যায়ের বিরদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে তিনি কোনো শক্তির কাছে সে যত বড়ই হোক আত্মসমর্পণ করেননি; মাথানত করেননি।
টুঙ্গিপাড়ার সেই দুরন্ত কিশোর শেখ মুজিবের নাম শুধু টুঙ্গিপাড়ায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার নাম ছড়িয়ে গেছে সারা বাংলায়, সারাবিশ্বে। পরিণত বয়সে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শোষিত, বঞ্চিত, গণমানুষের নেতা, স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা। তার সঠিক নেতৃত্বে এবং আহ্বানের কারণেই একাত্তরে বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপ দেয়, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ একটি পতাকা ও একটি মানচিত্র নিয়ে গর্ব করার সুযোগ পায়। তার অশেষ অবদান এবং আত্মত্যাগের জন্যই তিনি আজ আমাদের কাছে জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও বিশ্বনেতা।

বিশ্বনেতার ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার ও আত্মীয়স্বজনঃ
১৯৩৪ সনে দাদা আব্দুল হামিদের আদেশে শেখ মুজিবের বাবা ১৪ বছর বয়সে তার সঙ্গে তার বাবার সম্পর্কের আত্মীয় ৩ বছর বয়সের সদ্য পিতামাতাহীন বেগম ফজিলাতুন্নেসার বিয়ে দেন। বিয়ের ৯ বছর পর ১৯৪২ সালে শেখ মুজিবের ২২ বছর বয়সে ও ফজিলতুন্নেসার ১২ বছর বয়সে তারা দাম্পত্যজীবন শুরু করেন। এই দম্পতির ঘরে দুই কন্যা এবং তিন পুত্রের জন্ম হয়। কন্যারা হলেন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। আর পুত্রদের নাম শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল।

বিশ্বনেতার রাজনৈতিক জীবনঃ
১৯৪০ সাল শেখ মুজিব নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন এবং এক বছরের জন্য বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তাকে গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪২ সালে এসএসসি পাস করেন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে মানবিক বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হন এবং বেকার হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হয়। এ বছরই পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৪ সালে কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগদান এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন।

১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে কলকাতায় দাঙ্গা প্রতিরোধ তৎপরতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৯ সালে ২১ জানুয়ারি শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তি পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তাদের দাবি-দাওয়া আদালতের উদ্দেশ্যে ধর্মঘট ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানান। কর্মচারীদের এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অযৌক্তিকভাবে তাকে জরিমানা করে। তিনি এ অন্যায় নির্দেশ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯ এপ্রিল উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করার কারণে গ্রেপ্তার হন। ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় এবং জেলে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু এ দলের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’। এর প্রতিবাদে বন্ধি থাকা অবস্থায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাজবন্দি মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান। ১৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এ দাবিতে জেলখানায় অনশন শুর করেন। একটানা ১৭ দিন অনশন অব্যাহত রাখেন। পরে তাকে ঢাকা জেলখানা থেকে ফরিদপুর জেলে সরিয়ে নেওয়া হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন।

১৯৫৩ সালে ৯ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পাকিস্তান গণপরিষদের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী, একে ফজলুল হক ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে ঐক্যের চেষ্টা হয়। এই লক্ষ্যে ১৪ নভেম্বর দলের বিশেষ কাউন্সিল ডাকা হয় এবং এতে যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৫৪ সালে ১০ মার্চ প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট লাভ করে ২২৩ আসন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৪৩টি। বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জের আসনে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে ১৩ হাজার ভোটে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। ১৫ মে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। ৩০ মে বঙ্গবন্ধু করাচি থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং গ্রেপ্তার হন। ২৩ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালের ৫ জুন বঙ্গবন্ধু গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ২১ দফা ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৬ সালে ৩ ফেব্রæয়ারি আওয়ামী লীগ নেতারা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খসড়া শাসনতন্ত্রে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান। ১৪ জুলাই আওয়ামী লীগের সভায় প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করে একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের আনেন বঙ্গবন্ধু। ৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিল বের করা হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল আইয়ুুব খান সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি করা হয়। প্রায় চৌদ্দ মাস জেলখানায় থাকার পর তাকে মুক্তি দিয়ে আবার জেলগেটেই গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬১ সালে ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট করে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। ২ জুন চার বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটলে ১৮ জুন বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন। ২৫ জুন বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতারা আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার বিরূদ্ধে যৌথ বিবৃতি দেন। ৫ জুলাই পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু আইয়ুব সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। ২৪ জুলাই পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু আইয়ুুব সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু লাহোর যান, এখানে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় মোর্চা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এ সভায় দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় সংবলিত প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ১৪ দিন আগে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে মামলা করা হয়। এক বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬৬ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ। ১৯৬৮ সালে ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে। ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেট থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত আসামিদের মুক্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের বিচার কার্য শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে ৫ জানুয়ারি ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়। ১৯৭০ সালে ৭ ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন লাভ করে। ১৯৭১ সালে দীর্ঘদিনের স্বাধিকার আন্দোলন শেষে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

বিশ্বনেতার ত্যাগ ও কারাজীবনঃ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের বিশাল সময় কেটেছে কারাগারে। বাঙালি অধ্যুষিত তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠির শাসনের নামে শোষণের প্রতিবাদে সংগ্রাম করতে গিয়ে প্রায় ৪ হাজার ৬৮২ দিন তিনি কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। পাকহানাদার বাহিনী নানা টালবাহানা করে তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানোর অপচেষ্টাও করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের মত এত বেশি কারাভোগ দেশের এমনকি অন্য কোন দেশের আর কোন রাজনৈতিক নেতার করতে হয়নি।
তিনি স্কুলের ছাত্র অবস্থায় বৃটিশ শাসনামলে সাত দিন কারা ভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। বঙ্গবন্ধুর কারাভোগ নিয়ে তার ঘনিষ্ট সহচর, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং আওয়ামী লীগের প্রবীন নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের ১৪টি বছর কারাগারে ছিলেন। তিনি ১৯৩৮ সালে প্রথম কারাগারে যান। এরপর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি পাঁচ দিন কারাগারে ছিলেন। একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর আটক হয়ে মুক্তি পান ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি। এ দফায় তিনি ১৩২ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল আবারও কারাগারে গিয়ে ৮০ দিন কারাভোগ করে মুক্তি পান ২৮ জুন। ওই দফায় তিনি ২৭ দিন কারাভোগ করেন। একই বছরের ১৯৪৯ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ দিন এবং ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন।

তোফায়েল আহমেদ আরো বলেছিলেন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পরও বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে যেতে হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধু ২০৬ দিন কারা ভোগ করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির পর বঙ্গবন্ধু ১১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন। এ সময়ে টানা ১ হাজার ১৫৩ দিন তাঁকে কারাগারে কাটাতে হয়। এরপর ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি আবারও গ্রেপ্তার হয়ে মুক্তি পান ওই বছরের ১৮ জুন। এ দফায় তিনি কারাভোগ করেন ১৫৮ দিন। এরপর ’৬৪ ও ’৬৫ সালে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি ৬৬৫ দিন কারাগারে ছিলেন। আওয়ামী লীগের এ প্রবীন নেতা বলেন, ছয় দফা দেওয়ার পর জাতির পিতা যেখানে সমাবেশ করতে গেছেন, সেখানেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। ওই সময়ে তিনি ৩২টি জনসভা করে বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ’৬৬ সালের ৮ মে আবারও গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পান। এ সময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ দফায় তিনি কারাগারে ছিলেন ২৮৮ দিন। যুদ্ধবর্তী সময়ে মুজিবের পরিবারকেও গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিলো।

স্বাধীন বাংলা বিনির্মাণে ঐকান্তিক প্রচেষ্টাঃ
বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন দারিদ্র্যের কদর্য কশাঘাতে মানুষ কীভাবে দুর্দশার চরম শিখরে পৌঁছে সর্বস্বান্ত হয়। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে পিতা শেখ লুতফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুন কিভাবে পরম মমতায় গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াতেন, অন্ন-বস্ত্রের সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছিলেন। তাই তো বস্ত্রহীন পথচারীকে গায়ের জামা খুলে দিয়ে এলেও এবং পিতার অনুপস্থিতিতে পারিবারিক গোলা থেকে ক্ষুধার জ্বালায় জর্জরিত গরিব-দুঃখীকে ধান বিতরণ করে শেখ মুজিবকে পিতার স্বস্নেহ অনুমোদন পেতে কষ্ট হয়নি। এরপর ঘটনাবহুল দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি পদে বাধা-বিপত্তি প্রতিক্রিয়ার জাল ছিন্ন করে ১৯৬২ সাল থেকে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তা করছিলেন। দুঃখী বাঙালির অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের কৃতসংকল্প ভাবনাই দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন শেখ মুজিব। শহর, বন্দর, নগর ছাপিয়ে গ্রামবাংলার কোটি মানুষ বাঁশের লাঠি সজ্জিত হয়ে খান সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করতে রাস্তায় নেমে পড়েন। কারণ নেতা তাদের শেখ মুজিব ডাক দিয়েছেন স্বাধীনতার।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেন। ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করেন, আওয়াামীলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং মুজিবসহ আওয়ামীলীগের অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ও জনসাধারণের অসন্তোষ দমনে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়ি থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মূল ঘোষণার অনুবাদ – “এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক। “পৃথিবীর ইতিহাসে নেতার নির্দেশে এভাবে স্বাধীনতার লড়াই করতে ঝাঁপিয়ে পড়ার নজির নেই। শহীদানের রক্তগঙ্গায় বহু সাগর পেরিয়ে বহুমূল্যে এলো স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ পূর্ণতা লাভ করে। চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করলেও জাতির উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অপূর্ণতা থেকেই যায়। দেশজুড়ে বিজয়ের এত আনন্দ-উল্লাসের মাঝে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুই অনুপস্থিত। এ অবস্থায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চাপে পাক সামরিক সরকার বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনঃ
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী তিনি স্বাধীন স্বদেশের বুকে ফিরে আসেন. সেদিন সারা দেশ থেকে মানুষ ছুটে আসেন তাদের নেতাকে, বিশ্বনেতাকে একবার দেখার জন্য। স্বাধীন দেশে ফিরে বাঙালির ভালবাসায় সিক্ত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিমানবন্দর থেকে লাখ লাখ জনতার জনসমুদ্র পাড়ি দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স) দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে বলেছিলেন, বাঙালি আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছে সেই বাঙালির জন্য আমি রক্ত দিতেও প্রস্তুত ।

প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বঙ্গবন্ধুঃ
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময় ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচন হয়। আর সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ছিল ১৫টি। ঐ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ৭ এপ্রিল, তেজগাঁওয়ে অবস্থিত তখনকার জাতীয় সংসদ ভবনে। নির্বাচনে আওয়াামীলীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে জয়লাভ করে। বঙ্গবন্ধু সে সময় ঢাকা-১২ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন। ৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামীলীগ, সিপিবি ও ন্যাপের সমন্বয়ে ঐক্য-ফ্রন্ট গঠিত।
 ১৯৭৪ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দান। ২৩ ফেব্রুয়ারি ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গমন করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। ১৯৭৫ সালে ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ। ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ গঠন। বঙ্গবন্ধু ২৫ ফেব্রুয়ারি এই জাতীয় দলে যোগদানের জন্য দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান।
১৯৭৪ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দান। ২৩ ফেব্রুয়ারি ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গমন করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। ১৯৭৫ সালে ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ। ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ গঠন। বঙ্গবন্ধু ২৫ ফেব্রুয়ারি এই জাতীয় দলে যোগদানের জন্য দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান।
স্ব-পরিবারে হত্যাকান্ড:
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম, নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য হত্যাকান্ড ছিল বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যূষে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যরা ট্যাঙ্ক দিয়ে প্রথমে রাষ্ট্রপতির ধানমন্ডিস্থ বাসভবন ঘিরে ফেলে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমাকে হত্যা করে। ঘাতকেরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।

পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্তবাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্তসত্তা স্ত্রী আরজু মণি, আবদুল নাঈম খান রিন্টু, কর্নেল জামিল। কেবল তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে বেঁচে যান। তাদের বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, ওইদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে কাপুরুষোচিত হামলা চালায় ঘাতকরা। এ নারকীয় হামলায় ভবনের প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো। গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল দেওয়াল। চারপাশে রক্তের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক, বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ। তাঁর তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁজরা। পাশেই পড়ে ছিল তাঁর ভাঙা চশমা ও তামাকের পাইপ। ষড়যন্ত্রকারী ও ঘাতকরা চেয়েছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিতে। কিন্তু যে নাম প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে আছে সে নাম যে মুছে ফেলা যায় না, ঘাতকেরা তা বুঝতে পারেনি।
বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ
স্বাধীনতার অপর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ রকম কত নামেই না শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকা হয়। তার মা-বাবার আদরের ডাকনাম ‘খোকা’ এখন ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’, ‘স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা’, ‘জাতির পিতা’, ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘বাংলাদেশের জনক’সহ আরও অনেক নামে অভিষিক্ত। কিন্তু সার্বিকভাবে তিনি একটি আদর্শের নাম। যে আদর্শে উদ্ভূত হতে পারে বিশে^র যেকোন দেশের স্বাধীনতাকামী জনগণ। শিক্ষা নিতে পারে বিশ্বনেতার জীবনের প্রত্যেকটি স্তর থেকে, প্রত্যেকটি ত্যাগ থেকে, প্রত্যেকটি অবদান থেকে। যেভাবে পুরো বাঙালি জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই নেতার আহবানে, বিশ্বের বুকে জন্ম দিয়েছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।
অসীম সাহস ও দেশপ্রেমের জন্য বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিশ্বনেতাদের কণ্ঠেও ভেসে উঠেছে বঙ্গবন্ধুবন্দনা। কিউবার লৌহমানব ফিদেল কাস্ত্রোর বিখ্যাত সেই উক্তি এখনো বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করে- “আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তিনি হিমালয়”।বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তাঁর অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।”আর ভারতের সাবেক রাষ্টপতি প্রণব মুখার্জীর কাছে তো বঙ্গবন্ধু বিশেষ কিছু। তাঁর মতে, “বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সাহসী নেতা। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে এটাই পরিলক্ষিত হয়-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, তিনি বিশ্বনেতা।
‘মুজিববর্ষ’ পালনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবনী পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে তার মাহাত্ম বিশ্বময় ছড়িয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা। এতে আগামী শতবর্ষ ধরে বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিকতা উজ্জ্বলভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখিকা: সহকারী শিক্ষিকা,
টিএন্ডটি গেইট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়।
খাগড়াছড়ি ও ICT4E জেলা অ্যাম্বাসেডর এবং সেরা কন্টেন্ট নির্মাতা (শিক্ষক বাতায়ন)।
