কল্পনা চাকমা অপহরণের পূর্বাপর

কল্পনা চাকমা অপহরণের পূর্বাপর

কল্পনা চাকমা অপহরণের পূর্বাপর
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

সোহেল আহমেদঃ

১১ ই জুন ১৯৯৬। কল্পনা চাকমা তার নিজ বাড়ী লাইল্যাঘোনা, বাঘাইছড়ি, রাঙ্গামাটি হতে অপহৃত হন। তিনি হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। কল্পনা চাকমার ভাই কালিন্দি কুমার চাকমা অজ্ঞাত ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করে ১২ ই জুন ১৯৯৬ সালে বাঘাইছড়ি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ২/৯৬১ তারিখ ১২/৬/১৯৯৬ ইং, ধারা ৩৬৪।

১৩ জুন ১৯৯৬ ইং তারিখে কল্পনা চাকমার আরেক ভাই লাল বিহারী চাকমা (ক্ষুদিরাম) লেঃ ফেরদৌসসহ আরও ৩ জন ভিডিপি সদস্যকে চিনতে পেরেছে বলে দাবি করে। শান্তি বাহিনীর ক্রমাগত চাপে এবং প্রাণ নাশের হুমকিতে লাল বিহারী চাকমা ঘটনার সময় গোলাগুলি হয়েছিল এবং তাদের দুই ভাইকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছিল বলেও দাবি করে। কিন্তু সেনাবাহিনী কর্তৃক কথিত গোলাগুলিতে কল্পনা চাকমার দুই ভাই কালিন্দি চাকমা ও লাল বিহারী চাকমা নিহত তো হনই নাই, এমনকি আহতও হন নাই।

তৎকালীন শান্তি বাহিনী কল্পনা চাকমা অপহরণের দায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপর চাপাতে চায় এবং বিভিন্ন ফোরামে তা বলার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এটি তৎকালীন সরকারের দৃষ্টিগোচর হলে সত্য উদঘাটনে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। ১৯৯৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোঃ আবদুল জলিলকে সভাপতি করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট এ তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এই তদন্ত কমিটি তদন্ত কাজ শুরু করলে কল্পনা চাকমার পরিবার থেকেই অসহযোগিতা শুরু হয়। তারা তদন্ত কমিটির নিকট সাক্ষ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে, উপস্থিতির সময় দিয়েও অনুপস্থিত থাকে, তদন্ত হবার আগেই তদন্ত কমিটির উপর আস্থা নাই বলে বক্তব্য প্রচার করতে থাকে। এদিকে তদন্ত কমিটির নিকট স্বাক্ষী না দেয়ার জন্য শান্তি বাহিনী I এলাকার উপজাতি, বাঙালি নির্বিশেষে সকলের উপর চাপ অব্যাহত রাখে। এমনকি I এলাকায় স্বাক্ষীরা তদন্ত কমিটির নিকট হাজির হওয়ার সময় শান্তিবাহিনী কর্তৃক পথে পথে বাধাগ্রস্থ হয় এবং স্বাক্ষী দেয়া থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। শত প্রতিকুলতা উপেক্ষা করে তদন্ত কমিটির তাদের নিরপেক্ষ তদন্ত কাজ অব্যাহত রাখে। তদন্ত কমিটি কল্পনা চাকমার ব্যবহার্য জিনিসপত্র তদন্ত কমিটির সামনে উপস্থাপন করতে বললেও কল্পনা চাকমার পরিবার তার (কল্পনা চাকমার) ব্যবহার্য পোষাক, বই পুস্তক, ছবির এ্যালবাম, চিঠিপত্র, প্রসাধনী ইত্যাদি উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। এছাড়াও তদন্ত কমিটির জেরার মুখে কল্পনা চাকমার মা বাধুনি চাকমা বলে ছিলেন কল্পনা চাকমা অন্তর্ধানে চলে যাবার পর ২ বার তার (মা) সাথে কল্পনা চাকমার যোগাযোগ হয়েছে এবং সর্বশেষ যোগাযোগ হয় ১৯৯৬ সালের ১লা আগস্ট। যা হোক, বিস্তারিত তদন্ত শেষে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি কল্পনা চাকমা নিজ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক নিখোঁজ হয়েছে বলে মতামত প্রদান করে। তবে কমিটি এ ঘটনায় কাউকে দায়ী করেনি এবং কারো বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেনি।

১৭ জানুয়ারি ১৯৯৭ তারিখে বাঘাইছড়ি থানার মামলাটি জেলার বিশেষ শাখায় স্থানান্তর করা হয়। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর মামলাটি পুনরায় বাঘাইছড়ি থানা গ্রহণ করে এবং দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে ২০১০ সালের ২১ মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। সেখানেও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কল্পনা চাকমার অন্তর্ধান রহস্যের সাথে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়নি। বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা ইউপিডিএফ (মূল) এর চাপের মুখে আদালতে না রাজী আবেদন করলে আদালত ২০১০ সালের ২ সেপ্টেম্বর মামলাটি তদন্তে সিআইডি, চট্টগ্রাম জোনকে নির্দেশ দেয়। সিআইডি ২ বৎসর তদন্তের পর ২০১২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। বাদী কালিন্দী চাকমা পুনরায় ইউপিডিএফ (মূল) এর চাপে নারাজী প্রদান করে। ১৬ জানুযারি ২০১৩ সালে আদালত ৪ দফা নির্দেশনা দিয়ে রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপারকে তদন্তের ভার দেয়। তদন্তের প্রয়োজনে কল্পনা চাকমার ২ ভাইয়ের ডিএনএ সংগ্রহের জন্য অনুমতি চাইলে আদালত ২২ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে নমুনা সংগ্রহের আদেশ প্রদান করে। কালিন্দী কুমার চাকমা ও লালবিহারী চাকমা (ক্ষুদিরাম) ডিএনএ দিতে রাজী না হয়ে ১৪ মার্চ ২০১৪ তারিখ আদালতে আবেদন করলে আদালত পূর্বের আদেশ বহাল রাখে। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে পুলিশ দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়েও কল্পনা চাকমার তথাকথিত অপহরণের কোন তথ্য, প্রমাণ এবং স্বাক্ষী না পাওয়ায় আদালতে মামলার কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য আবেদন করে। ২৫ এপ্রিল ২০১৮ তারিখ রাঙ্গামাটি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর আদালতে কল্পনা চাকমার তথাকথিত অপহরণ মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে আদালত আগামী ০৯ জুলাই ২০১৮ তারিখ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন।

১৯৯৬ সালের ১২ ই জুন ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কল্পনা চাকমা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শান্তি বাহিনীর সমর্থিত প্রার্থী বিজয়কেতন চাকমাকে সমর্থন না করে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিপঙ্কর তালুকদারের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়, যা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও শান্তি বাহিনীর নীতি পরিপন্থি ছিল। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে কল্পনা চাকমার বিপরীত মুখী ভূমিকার কারনে বিষয়টি দলের নেতাদের জন্য ভীষণ রকম বিব্রতকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এছাডাও শান্তি বাহিনীর প্রার্থী বিজয়কেতন চাকমারও নির্বাচন পরাজয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। দলের মধ্যে তখন দলের নীতির বিরোধিতাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি প্রদানের দাবিটিও সোচ্চার হচ্ছিল। তাই তখন দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারনে কল্পনা চাকমাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

অপরপক্ষে, ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সাল পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য সফলতার বৎসর। এ সময় কালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস দমন ও অস্ত্র উদ্ধারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভীষণভাবে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছিল। এ সময় প্রথম সারীর সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও বিপুল পরিমান অস্ত্র উদ্ধার সম্ভব হয়েছিল। সেনাবাহিনী কর্তৃক বিপুল পরিমান অস্ত্র ধরা পড়ায় ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি শান্তি বাহিনী তার সামরিক সক্ষমতা বহুলাংশে হারিয়ে ফেলে। এর প্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে শান্তি বাহিনী শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরে আগ্রহী হয়ে উঠে। যা হোক এ সময়ে সেনাবাহিনীর কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য, ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য, দেশী বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য শান্তি বাহিনীর পক্ষে একটি গ্রহনযোগ্য ইস্যুর প্রয়োজন ছিল। তাই তৎকালীন শান্তিবাহিনী পরিকল্পিত ভাবে কথিত কল্পনা চাকমা অপহরণের ইস্যুটি তৈরি করে দেশী বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়।

যেভাবে কল্পনা চাকমা অপহরণের গল্পটি প্রচার করা হয়েছে তার সাথে বাস্তবতার যথেষ্ট অমিল রয়েছে। উপরোল্লিখিত ঘটনাবলী বিশ্লেষণে করলে দেখা যায় যে, প্রথমত কল্পনা চাকমা অপহরণের সময় তার দুই ভাইকে লক্ষ্য করে গুলি করলে তাদের নিহত বা আহত হবার কথা, কিন্তু তারা আহত বা নিহত হননি। দ্বিতীয়ত গোলাগুলির শব্দ হলে আশেপাশের লোকজনের গুলির শব্দ শোনার কথা কিন্তু অত্র এলাকায় কেউ গুলির শব্দ শুনতে পায়নি। তৃতীয়ত কল্পনা চাকমা অপহৃত হলে তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র বাড়ীতে থাকার কথা কিন্তু তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র বাড়ীতে না থাকায় তার পরিবার কর্তৃক তা তদন্ত কমিটির নিকট উপস্হাপন করতে পারেনি। চতুর্থত ২০০১ সালে হিল উইমেন্স ফেডারেশন “”কল্পনা চাকমার ডায়েরী’’ নামে বই প্রকাশ করেছে সেখানে কল্পনা চাকমাকে তার স্বামীসহ ভারতের ত্রিপুরায় দেখা গিয়েছে বলে উল্লেখ আছে। এ থেকেই স্পষ্টই বোঝা যায় যে, কল্পনা চাকমা অন্তর্ধানের সাথে সেনাবাহিনীর কোন সম্পৃক্ততা নেই।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

কল্পনা চাকমার নিখোঁজ হবার বিষয়টি মূলতঃ পাহাড়ি সংগঠন গুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের ফলাফল হবার সম্ভাবনা বেশী। শান্তি বাহিনীর সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে আড়াল করতে এবং সেনাবাহিনীর সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এহেন প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস দমন ও অস্ত্র উদ্ধারে লেঃ ফেরদৌসের অনেক বড় বড় সফলতা থাকায় তার প্রতি শান্তি বাহিনীর ক্ষোভ ছিল। এছাড়াও লেঃ ফেরদৌস ঘটনার সময় অত্যন্ত কনিষ্ঠ অফিসার হওয়ায় এটি সকলের নিকট হয়তো বিশ্বাসযোগ্য হবে। মূলতঃ এ কারণেই কল্পনা চাকমা অপহরণের কাল্পনিক গল্পে লেঃ ফেরদৌসকে জড়ানো হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এ অবস্থায় পূর্ণাঙ্গ টহলদল ব্যতিত ক্যাম্পের বাহিরে যাবার কোন সুযোগ, পরিস্থিতি এবং অনুমতি ছিল না। কিন্তু কথিত অপহরণকালে লেঃ ফেরদৌসের সাথে সেখানে সেনা টহলদল উপস্থিত ছিল না বলে শোনা যায়। লেঃ ফেরদৌস একজন সেনা কর্মকর্তা। যেকোন ঘটনায় তার সাথে সেনাসদস্য সংশ্লিষ্ট থাকাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু কল্পনা চাকমার কল্পিত অপহরণের ঘটনায় কোন সেনাসদস্য সংশ্লিষ্ট থাকার কথা শোনা যায়নি, তবে ৩ জন ভিডিপি সদস্য জড়িত ছিল বলে শোনা গেছে। সেনা কর্মকর্তার সাথে সেনা সদস্য সংশ্লিষ্ট না থেকে ভিডিপি সদস্যের সংশ্লিষ্ট থাকায় কল্পিত এ অপহরণের ঘটনাটি “”বানোয়াট’’ বলেই প্রমাণিত হয়।