শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ এবং স্থাণীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন - Southeast Asia Journal

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ এবং স্থাণীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

রিফাত শাহেদ রিদম:

১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ ২১ বছরের ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত এবং রক্তক্ষরণের অবসান ঘটে। তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অন্য কোনো তৃতীয়পক্ষের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এই শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত।

ছবি-১: পার্বত্য শান্তি চুক্তির সময় অস্ত্র সমর্পনের দৃশ্য।
ছবি-২: পার্বত্য শান্তি চুক্তির সময় অস্ত্র সমর্পনের আগে শান্তিবাহিনী সদস্যদের অপেক্ষমান দৃশ্য।

চুক্তি অনুযায়ী, খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা সন্তু লারমার নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট অস্ত্র সমর্পণ করেন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালের ৬ই মে স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন সংশোধন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন সংসদে পাস হয়। ওই বছরের ১৫ই জুলাই এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয় এবং খাগড়াছড়ির তৎকালীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কল্প রঞ্জন চাকমাকে প্রথম পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর সরকার কর্তৃক জনসংহতি সমিতির প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাকে চেয়ারম্যান করে ২২ সদস্যের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১২ই মে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) দায়িত্বভার গ্রহণের মাধ্যমে আঞ্চলিক পরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়।

ছবি-৩: পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি নারীরা।

শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর থেকে বিগত ২০ বছরে এর বাস্তবায়নে সরকার বেশ আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছে। এ পর্যন্ত শান্তিচুক্তির মোট ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টির পূর্ণ বাস্তবায়ন, ১৫টির আংশিক বাস্তবায়ন এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় হস্তান্তরযোগ্য ৩৩টি বিষয়/বিভাগের মধ্যে এ পর্যন্ত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে ৩০টি, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে ৩০টি এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে ২৮টি বিষয়/দফতর হস্তান্তর করা হয়েছে।

ছবি-৪: পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর উপজাতিদের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সরকারের আন্তরিকতা ও অব্যাহত প্রচেষ্টার কারণে শান্তিচুক্তির পর হতে এ যাবতকাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে এবং এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। চুক্তির সুফল হিসেবে পাহাড়ের সকল মানুষ বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করছে। সমতলের জেলাগুলোর মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতেও বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা গড়ে উঠেছে। সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ করে ইতোমধ্যে পাহাড়ের সব উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যন্ত পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালে মাত্র ৪৮ কি.মি. রাস্তা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য অঞ্চলে নির্মাণ করেছে প্রায় ১৫৩৫ কি.মি. রাস্তা, অসংখ্য ব্রিজ ও কালভার্ট।

ছবি-৫: বান্দরবানের রুমা সড়ক উদ্বোধনের দৃশ্য।

পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি স্থল বন্দর নির্মাণ করা হবে এবং টেলিযোগাযোগের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বাণিজ্য এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রেও প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে দেশি এবং বিদেশি প্রায় ১২০ টি এনজিওসমূহের কার্যক্রম, পার্বত্যাঞ্চলে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগ সড়ক, অরক্ষিত সীমান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধান, সম্পূর্ণ একটি ব্রিগেডসহ ২৪০ টি অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার, পার্বত্যাঞ্চলে মোতায়নরত সেনাবাহিনীকে ছয়টি স্থায়ী সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন, সামাজিক উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৩ পার্বত্য জেলায় ৪১ হাজার ৮৪৭ জনকে বয়স্ক ভাতা, ২২ হাজার ৪১০ জনকে বিধবা ভাতা, ৭ হাজার ৩১১ জনকে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা এবং ৯৮১ জন প্রতিবন্ধীকে শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় এ অঞ্চলে ১ হাজার ৪৬টি সমিতির মাধ্যমে ৫২ হাজার ১৭২ জন সদস্যের দারিদ্র্য বিমোচন তথা জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে।

ছবি-৬: পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির দৃশ্য।

শিক্ষার ক্ষেত্রেও পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের ছোঁয়া ব্যাপকভাবে লেগেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ ছিলো না সরকার সেখানে নতুন করে ১টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১টি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছে। আশির দশকে যেখানে উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের সংখ্যা ছিলো মাত্র ১১টি সেটা এখন ৪৭৯টি,  প্রায় প্রতিটি পাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শিক্ষার হার ২ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪৪.৬২ শতাংশে এ পৌঁছেছে। যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষার হার ৫৯.৮২ শতাংশ সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের শিক্ষার হার ২৩%।

ছবি-৭: রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার পর্যটন স্পট সাজেক।

এছাড়াও, পার্বত্য চট্টগ্রামে কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১টি থেকে ৩টি করা হয়েছে, হাসপাতালের সংখ্যা ৩টি থেকে ২৫টিতে উন্নীত হয়েছে। যেখানে কোন খেলার মাঠ ছিলো না বর্তমানে সেখানে ৫টি স্টেডিয়াম নির্মিত হয়েছে। কলকারখানা, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ১৯৩টি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১৩৮২টিতে উন্নীত হয়েছে। ফলে সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এককালের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রভূত উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

পাশাপাশি, সরকার চাকরি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে উপজাতিদের জন্য ৫ শতাংশ রিজার্ভ কোটার ব্যবস্থা করেছে, উপজাতিদেরকে সরকারি ট্যাক্সের আওতামুক্ত রেখেছে। বর্তমানে সরকার কর্তৃক শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের জন্য জন্য বিভিন্ন সরকারী মেডিকেল কলেজে ১০ টি, ডেন্টাল কলেজে ০১ টি, বিভিন্ন কলেজে ১৪ টি, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ০৩ টি, বিভিন্ন কৃষি কলেজে ০৩ টি, নোয়াখালী কৃষি ডিপ্লোমা কলেজে ০২ টি, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ০৩ টি, বিভিন্ন প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ে ০৩ টি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ টি, ক্যাডেট কলেজে ০৫ টি, রাংগামাটি প্যারা মেডিকেল কলেজে ১৬ টি এবং বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসমূহে ২৯ টি সর্বমোট ৯৯ টি রিজার্ভ কোটা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সকল উপজাতিদের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে আরো ৭৫ টি রিজার্ভ কোটা রাখা হয়েছে যার সুবিধা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরাও ভোগ করতে পারছে। এখানে উল্লেখ্য যে, দেশের সমতলের অন্যান্য সকল উপজাতিদের জন্য ৫৭ টি রিজার্ভ কোটা রক্ষিত আছে। এ সবই করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের আর্থ-সামাজিক ও জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে। সরকার প্রদত্ত এ সকল সুবিধা ভোগ করে শিক্ষা, চাকরি এবং জীবনযাত্রার মানের ক্ষেত্রে উপজাতিদের ব্যাপক উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। দিন দিন এ অবস্থার আরও উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।

ছবি-৮: পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা বয়সের উপজাতি নারীরা।

শান্তিচুক্তি পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে নীলগিরি, নীলাচল, স্বর্ণমন্দির, বগালেক, শৈলপ্রপাত, আলুটিলা গুহা, মিরিঞ্জা, রাজবন বিহার, মেঘলা, সাজেক প্রভৃতির মতো উন্নত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন আরও অনেক আকর্ষণীয় ও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেf পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪৫টি নয়নাভিরাম পর্যটন স্পট রয়েছে। সেগুলো সঠিকভাবে বিকাশকরতে পারলে প্রতিবছর ১৫-২০ হাজার কোটি টাকা উপার্জন করা সম্ভব। এতে করে রাষ্ট্র যেমনঅর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে তেমনি পর্যটন বিকাশের ফলে স্থানীয় পাহাড়ি জনসাধারণের একটি বিরাটঅংশ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে।

প্রকৃতপক্ষে, শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি অন্য সকল পক্ষের সম্মিলিত ইচ্ছা ও চেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। “আমি” বা “তুমি” এবং “আমরা” বা “তারা”য় বিভক্ত না হয়ে, সবাই মিলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখলে পার্বত্য এলাকায় শান্তির পরিবেশ আরও সুসংহত হবে এবং সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সার্বিক উন্নয়ন সাধিত হবে।