পাহাড়ে নারীদের প্রতিবন্ধকতা ‘সন্ত্রাস-রীতিনীতি’!

পাহাড়ে নারীদের প্রতিবন্ধকতা ‘সন্ত্রাস-রীতিনীতি’!

পাহাড়ে নারীদের প্রতিবন্ধকতা ‘সন্ত্রাস-রীতিনীতি’!
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

ইফতেখার ইসলাম

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি—এই তিন জেলার অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রেখে আসছেন নারীরা। ঘরে বাইরে প্রতিনিয়ত কাজের মধ্যে দিন কাটালেও অধিকারের বিষয়ে বরাবরের মতো বঞ্চিত হয়ে আসছেন তারা। পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইউপিডিএফ, জেএসএস, ও কেএনএফ’র মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। এ ছাড়া পাহাড়িদের নিজস্ব রীতিনীতির বেড়াজালে নারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন নিজেদের অধিকার থেকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাহাড়ে নারীদের অগ্রগতির পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর তৎপরতা। এসব সংগঠন পাহাড়িদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে এমনটা দাবি করে আসলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এই সংগঠনগুলোর যত কার্যক্রম সবকিছুর পেছনে রয়েছে আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি এবং অন্যসব পাহাড়িদের নিজেদের অধীনস্ত করে রাখা।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও পাহাড়ের সংঘাত নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবুজ-শান্ত পাহাড়ে অশান্তির ছায়া পড়েছে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কারণে। যারা প্রতিনিয়ত অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজিতে মগ্ন। এসবের কারণে অনেক সময় ভয়-আতঙ্কে বন্ধ রাখতে হয় পাহাড়ি স্কুলগুলো, বাধাগ্রস্ত হয় পাহাড়ের উন্নয়নে। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যরা নারীদের ব্যবহার করেন বিভিন্ন অপকর্মে। নারীদের পড়া্শোনায় নিরুৎসাহিত করে ধাবিত করেন অজ্ঞতার অন্ধকারে। মূলত এসব সন্ত্রাসীরা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে নারীদের মূর্খ করে রেখ দিতে চান। পাহাড়ি নারীরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত হন নিজ সম্প্রদায়ের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে। যৌন সহিংসতা, অপহরণ, ধর্ষণ, এমনকি হত্যা পর্যন্ত ঘটছে প্রতিনিয়ত। যার জলজ্যান্ত উদাহরণ রয়েছে দুদিন আগে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে ঘটে যাওয়া বন্দনার মা হত্যার ঘটনায়।

পাহাড়ি নারীদের বঞ্চিত করছে রীতিনীতি 

পাহাড়ের নারীরা বাস করছেন ৬ চ্যালেঞ্জ নিয়ে। বৈষম্যমূলক আচরণ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, ভরণপোষণ ও নির্যাতন—এসব দুর্ভোগ নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের কারণে-ই। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রচলিত আইন আর প্রথাগত নিয়মের বিরোধে পিষ্ট হচ্ছেন পাহাড়ি নারীরা। সমতলের মুসলিম, হিন্দু এবং খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য নারীরা পিতা বা স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ সংক্রান্ত প্রমাণপত্র এবং অন্যান্য সামাজিক অধিকার যথাযথভাবে পেলেও পাহাড়ি নারীরা তাদের এ জাতীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত। এসব জনগোষ্ঠীর বসবাস বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে হলেও, তারা নারীদের অধিকারের বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধান, আইন-এর শাসন ইত্যাদি অনুসরণ না করে নিজেদের প্রথাগত রীতিনীতি এবং পদ্ধতিগত ঐতিহ্য অনুসরণ করেন।

পার্বত্য অঞ্চলের মানবাধিকার কর্মীরা বলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে পাহাড়ি নারীরা সম্পত্তির মালিক হতে পারেন না। বাবা মারা গেলে ওই সম্পত্তির মালিক হচ্ছেন ছেলেরা। আবার কারও ছেলে সন্তান না থাকলে সম্পত্তি পাচ্ছেন ভাইয়ের ছেলেরা। পার্বত্য জেলাগুলোতে হেডম্যান ও কার্বারি সিস্টেম রয়েছে। তারা পারিবারিক আদালতের মতো বিচার-আচার করেন। এসব বিচারেও বেশিরভাগ নারী ন্যায় বিচার পাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে উপজাতি নারীদের সামাজিক মর্যাদা নানাভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। বিবাহের নিবন্ধন না থাকায় বর্তমান পাহাড়ি যুব সমাজের মধ্যে একাধিক বিবাহ করার প্রবণতার পাশাপাশি পূর্বের স্ত্রীকে অস্বীকার ও ভরণপোষণ সঠিকভাবে প্রদান না করার ঘটনা ঘটছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পাহাড়ি নারীরা চরমভাবে অবমূল্যায়িত হলেও বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের আশ্রয় নিতে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাহস পান না। সমাজ তাদের একেবারেই সহযোগিতা করে না। তাই বাধ্য হয়ে তাদের সাম্প্রদায়িক প্রথা এবং সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী স্থানীয় হেডম্যান ও কারবারির করা বিচারের রায় মাথা পেতে মেনে নিতে হয়।

পাহাড়ে নারীদের এসব অধিকার নিয়ে নারীকর্মী ও মানবাধিকার কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে আরোচনা করে আসলেও তেমন সুফল দেখা যাচ্ছে না। তবে সম্প্রতি বান্দরবানের থানচিতে পাহাড়িদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের বিষয়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। মার্চরে মাঝামাঝি থেকে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে।

উপার্জন করেও ব্যয়ের অধিকার নেই

পাহাড়ে উৎপাদনের প্রতিটি সেক্টরে মুখ্য ভূমিকা রয়েছে নারীদের। উৎপাদন থেকে শুরু করে পণ্য বাজারজাতকরণসহ সমাজের বিভিন্ন কাজে পাহাড়ি নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করে যান। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। মূল জনগোষ্ঠীর নারীরা কাজের ক্ষেত্রে যেখানে এখনও অনেকটা পিছিয়ে সেখানে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নারীরা এক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে।

স্থানীয় অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে পাহাড়ি নারীরা জড়িত থাকলেও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় নিজেদের শ্রমে উপার্জিত অর্থ ব্যয়ে রয়েছে বৈষম্য। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার তথ্যমতে, রাঙ্গামাটির পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রায় দেড় লাখ নারীর ৮০ ভাগই ঘরের বাইরে কাজ করে পরিবারের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখছেন। তবে অর্থনৈতিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে তাদের পুরোপুরি স্বাধীনতা নেই। নিজেদের অর্জিত অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে এখনও তাদের নির্ভর করতে হয় পরিবারের কর্তার ওপর। প্রান্তিক পর্যায়ে নারীদের এ সমস্যা আরও প্রকট। জুম থেকে পণ্য উৎপাদন করে বাজারে নিয়ে বিক্রি। এরপর সেই অর্থ সংসারের কাজে ব্যয়। তারপরও নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারেনি প্রান্তিক পর্যায়ের নারীরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাহাড়ি নারীরা রাত-দিন পরিশ্রম করে সংসারের ঘানি টানে। আর পুরুষরা ঘুরে বেড়ায়, মাতাল হয়ে পড়ে থাকে, ঘরে বসে হুক্কা টানে। ঘরে-বাইরে সব কাজ করে সংসার সামলায় উপজাতি নারীরা। পুরুষরা শুধুই আরাম আয়েশ করে। কেউবা সতিনের সঙ্গে নিজের সোনার সংসার ভাগ করতে বাধ্য হয়। তারপরও স্বামীর নানারকম নির্যাতনও সহ্য করতে হয় নারীদের।

অন্যদিকে বাঙালি ছেলেদের সঙ্গে বিয়ের পর সংসারের সব কাজ করে পুরুষরা, নারীরা শুধু সংসার গোছানোর সহজ কাজগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে করতে পারে। সেই সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতিতে পরিচ্ছন্ন জীবনে উন্নত ভালোবাসা পেয়ে সুখী সংসার করে তারা। এসব খবর পাহাড়ি নারীদের কাছে ছড়িয়ে পড়ায় পাহাড়ের উপজাতি সব তরুণীর মনে মনে পছন্দের পুরুষ হয়ে উঠে বাঙালি তরুণরা। তাই ভালোবেসে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা।

কিন্তু পাহাড়ি কথিত আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর ছেলেদের মেয়েরা পছন্দ না করার কারণে সন্ত্রাসীরা ফুঁসে ওঠে। ভালোবাসা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়ে নারীদের ধর্ষণের জন্য ভিলেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তারা। পুলিশ প্রশাসন কঠোর হয়েও তাদের দমন করতে পারছে না।

বাঁধা ডিঙিয়ে পাহাড়ি নারীদের অনবদ্য ছুটে চলা

এত এত সমস্যা-বাধার মুখেও পাহাড়ের নারীরা আজ সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে চলছে। জুমে, মাঠে, ঘাটে, অফিস-আদালত—সবক্ষেত্রেই তাদের সরব পদচারণা। বহুবিধ অর্থনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত পাহাড়ি নারীরা। তারা যেমন কর্মঠ, তেমনি বিভিন্ন পেশা ও কাজকর্মে যুক্ত। গৃহস্থালির দৈনন্দিন কাজকর্মসহ পারিবারিক আয় থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, জুমচাষ, হস্ত ও ক্ষুদ্রশিল্প, আউটসোর্সিং—অফিস-আদালতে সরব উপস্থিতির মাধ্যমে পারিবারিক অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন।

সকাল হলেই পাহাড়ের নারীরা নেমে পড়েন জুমচাষের কাজে। কেউ জুমচাষে গর্ত করে বীজ বপনে ব্যস্ত, আবার কেউ ফসল কর্তনে ব্যস্ত। কেউ জমিতে ধান রোপণে ব্যস্ত, আবার কেউ মাঠে সবজি উৎপাদনের ব্যস্ত সময় পার করেন।পাহাড়ের স্থানীয় বাজারগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, এসব বাজার এখন স্থানীয় নারীদের দখলে। ভোর হলেই মাথায় হারাং নিয়ে বাজারগুলোতে বসে যায় পাহাড়ের বিভিন্ন রকমের ফলমূল কিংবা শাকসবজি নিয়ে। দিনব্যাপী বিকিকিনি করে বিকেল হলে বাসায় ফেরেন। পরদিন ভোর থেকে আবার জীবনযুদ্ধের একই চিত্র।

শুধু অর্থনীতির ক্ষেত্রেই নয়, গৃহস্থালির কাজে নিত্যদিনের কাজ এবং পরিবারের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য পাহাড়ি দুর্গম পথ মাড়িয়ে পানি সংগ্রহেও এগিয়ে আসে নারীরা। নিজের সন্তানকে আগলে রেখে সংসার ও অর্থনীতির কাজও সামাল দিয়ে যাচ্ছে পরিশ্রমী এসব নারী। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে অফিসের শীর্ষপদেও আসীন হয়েছেন তারা। জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যেতে কেউ কেউ এখন স্কুটির মাধ্যমে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং আত্মমর্যাদা অর্জনে পাহাড়ি নারীরা নানা ধরনের সংগ্রাম করে আসছেন। বিশেষ করে তাদের ভূমিকা কমিউনিটি উন্নয়ন, সৃজনশীল কার্যক্রম এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির দিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাঙামাটি আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট শ্রীজ্ঞানী চাকমা বলেন, পাহাড়ের নারীরা আগের চেয়ে অনেক অগ্রসর হয়েছে। শিক্ষার দিক থেকে আমরা অনেকটাই এগিয়ে গেছি। পাহাড়ের আনাচে কানাচে থেকে নারীরা এখন অনেক ক্ষেত্রেই ভালো ভূমিকা রাখছে। পাহাড়ে নারী হেডম্যান, কার্বারী রয়েছে, পাশাপাশি ক্রীড়া ক্ষেত্রে ঋতুপর্ণা, রুপনারা পাহাড়ের হয়ে ভূমিকা রাখছে।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

পাহাড়ে নারীদের উন্নয়নে সেনাবাহিনী

পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়িবাঙালি নারীদের ক্ষমতায়ন এবং আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে সেনাবাহিনী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই মেশিন বিতরণ ও প্রশিক্ষণ প্রদন করছে। এতে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি-বঙালি নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।

সেনা ক্যাম্পের সন্নিকটে অথবা উপজেলার সুবিধাজনক স্থানে সেনাবাহিনী হতদরিদ্র পাহাড়িবাঙালি মহিলাদের ক্ষমতায়ন এবং আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার প্রয়াসে কম্বল ও ব্যাগ ফ্যাক্টরি, কুটির শিল্প ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে অনেক পাহাড়িবাঙালি মহিলাকে চাদর, থামি, লুঙ্গি ও গামছা তৈরির প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে।

এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন তাঁত তৈরি ও কাঁচামাল ক্রয় বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করা হয়। বিভিন্ন গুচ্ছগ্রামে মহিলাদের কর্মসংস্থান তৈরিতে উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে মুরগির ফার্ম পরিচালনা ও এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদান, মাশরুম, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফল চাষের প্রশিক্ষণ ও প্রত্যক্ষ সহায়তা প্রদান করায় তাদের পারিবারিক ভরণপোষণ ক্ষমতা ও সচ্ছলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।