স্টারলিংক প্রকল্প: পাহাড়ে সুপ্রদীপের প্রযুক্তি বিপ্লব না গভীর পর্যবেক্ষণের ফাঁদ?

স্টারলিংক প্রকল্প: পাহাড়ে সুপ্রদীপের প্রযুক্তি বিপ্লব না গভীর পর্যবেক্ষণের ফাঁদ?

স্টারলিংক প্রকল্প: পাহাড়ে সুপ্রদীপের প্রযুক্তি বিপ্লব না গভীর পর্যবেক্ষণের ফাঁদ?
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মোঃ সাইফুল ইসলাম

পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তির হাওয়া লাগাতে চায় সরকার—শুরুতেই শোনায় যেন খুবই ইতিবাচক এক উদ্যোগ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই হাওয়ার গতিপথ কোন দিকে বইবে? সম্প্রতি সরকারের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা পাহাড়ি অঞ্চলের ১০০টি স্কুলে ‘স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট’ চালুর ঘোষণা দিয়ে বললেন—“এই উদ্যোগ শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত এক বিপ্লব হবে।” কিন্তু সচেতন পাহাড়ি মহলের একটা বড় অংশ বলছে, এটি শুধু একটি ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির প্রশ্ন নয়—বরং এটি হতে পারে পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর ওপর নজরদারির একটি নতুন অধ্যায়।

সোশ্যাল মিডিয়ায়, স্থানীয় সভা-সেমিনারে, এমনকি জাতীয় পর্যায়েও স্টারলিংক সংযোগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। কারণ, এই ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্ম পরিচালিত হয় আমেরিকার বেসরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স-এর মাধ্যমে। এ ধরনের যোগাযোগ অবকাঠামো স্থানীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থেকে সরাসরি একটি বিদেশি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের আওতায় গেলে তার নিরাপত্তা, নজরদারি ও তথ্যপ্রবাহ কাদের হাতে থাকবে—তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

সুপ্রদীপ চাকমা যদিও একে “প্রযুক্তিগত বিপ্লব” বলে দাবি করেছেন, কিন্তু তিনি একবারও উল্লেখ করেননি—এই ইন্টারনেট সংযোগের নেটওয়ার্ক নিরাপত্তা কেমন হবে, কীভাবে শিক্ষার্থীদের গোপনীয়তা নিশ্চিত করা হবে কিংবা এর কোনো রেগুলেটরি কাঠামো আদৌ থাকবে কি না। তার কথায় প্রতিফলিত হয়েছে, যেন এই উদ্যোগ ‘সহজভাবে গ্রহণযোগ্য’। অথচ পাহাড়ে সাম্প্রতিক সময়ে যারা ‘উন্নয়নের নামে নিয়ন্ত্রণ’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাদের দৃষ্টিতে এটি শুধুমাত্র একধরনের “ডিজিটাল উপস্থিতি” নয়—বরং ভবিষ্যতের তথ্য ও মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতি।

অন্যদিকে, সুপ্রদীপের ভাষ্য অনুযায়ী, “আমরা সবসময় কোটা পাবো না, প্রতিযোগিতা করতে হলে ভালো স্কুল-কলেজ গড়ে তুলতে হবে।” এখানে একটি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক ভাষ্য মিশে গেছে। কোটা বাতিলের পটভূমিতে পাহাড়ের জাতিসত্তাভিত্তিক গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ‘প্রতিযোগিতার কথা’ বলাটা কি পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের দায়ভার তাদের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া নয়?

আরও গভীর প্রশ্ন দেখা দেয়, যখন সুপ্রদীপ চাকমা একইসাথে বলেন—“আমার প্রধান চিন্তা স্যাটেলাইট শিক্ষাব্যবস্থা” এবং “উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে হোস্টেল নির্মাণ করতে হবে।” এই কথার মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর আবাসিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি নয়া কাঠামো গড়ে তোলার ইঙ্গিত আছে, যা একদিকে যেমন বিচ্ছিন্নতা তৈরি করবে, অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষার নামে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগও তৈরি করবে।

এই প্রেক্ষাপটে অনেকে মনে করছেন, তথাকথিত ‘স্টারলিংক বিপ্লব’ আসলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের আড়ালে পাহাড়ে একটি নতুন ধরণের তথ্য-নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তোলার কৌশল হতে পারে এবং সুপ্রদীপ চাকমা এই প্রকল্পের মূল প্রবক্তা হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়ছেন এক গভীর সন্দেহের কেন্দ্রে।

অতএব, প্রশ্নটা শুধু ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির নয়, বরং প্রশ্নটা দাঁড়ায়—এই প্রকল্পের মাধ্যমে পাহাড়ের শিক্ষার্থী, সংস্কৃতি এবং ভবিষ্যৎকে কার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে? সরকার কি প্রকৃত উন্নয়ন চায়, নাকি উন্নয়নের মোড়কে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তারের আরেকটি রূপরেখা তৈরি করছে?

সংক্ষেপে বলতে গেলে, স্টারলিংককে কেন্দ্র করে সুপ্রদীপ চাকমার বক্তব্য এবং সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে পাহাড়ে উদ্বেগ যে অমূলক নয়, তা স্পষ্ট হচ্ছে প্রকল্পের নকশা, বাস্তবায়ন কাঠামো এবং অংশীদারিত্ব বিশ্লেষণ করলেই। সময় এসেছে, এই উদ্যোগ নিয়ে পাহাড়ের জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পর্যালোচনার। উন্নয়ন হোক অংশগ্রহণমূলক— নিয়ন্ত্রণমূলক না।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

You may have missed