লংগদুর দুই মামলায় ইউপিডিএফের সশস্ত্র কমান্ডার মাইকেল চাকমার কারাদণ্ড
![]()
নিউজ ডেস্ক
প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন পাহাড়ের আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফের সশস্ত্র গ্রুপের কমান্ডার মাইকেল চাকমা ও তার সহযোগী সুমন চাকমাকে দুটি পৃথক মামলায় মোট ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
দীর্ঘ ১৮ বছর পর আজ বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) রাঙামাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল এই দুই মামলার রায় ঘোষণা করেন।
২০০৭ সালের ৩০ অক্টোবর লংগদু উপজেলার দুর্গম এলাকায় সশস্ত্র তৎপরতার সময় মাইকেল চাকমা ও সুমন চাকমাকে অস্ত্র ও চাঁদাবাজির টাকা সহ আটক করে সেনাবাহিনীর লংগদু জোন। পরবর্তীতে তাদের লংগদু থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং দুটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়—একটি চাঁদাবাজি মামলা, অপরটি অস্ত্র মামলা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৭ সালে ৩০ অক্টোবর রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু থানায় মো. দুলাল উদ্দিনের করা (মামলা নং-০৪) মামলার ১ নম্বর আসামি মাইকেল চাকমা এবং তার সহযোগীরা মিলে বাদি এবং অন্য জেলেদের বেদম মারধর করে সাথে থাকা টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং নিয়মিত হারে চাঁদা দেয়ার জন্য হুমকি দেয়। পরবর্তীতে, সেনা অভিযান পরিচালনা করে মাইকেল চাকমাকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদসহ গ্রেফতার করা হয়।
চাঁদাবাজি মামলা
লংগদু থানা মামলা নং ৪, তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০০৭ (SC 36/9, দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৮৫ ধারা অনুযায়ী) — মামলায় অভিযোগ ছিল যে, মাইকেল চাকমা ও সুমন চাকমা লংগদু এলাকায় স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে সন্ত্রাসের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করছিল।
দীর্ঘ শুনানি শেষে আজ বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর ২০২৫) রাঙামাটি জেলা জজ আদালত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। আদালত উভয় আসামিকে চাঁদাবাজির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে ৮ বছর সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন।
অস্ত্র ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম মামলা
অন্যদিকে, একই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দায়ের করা দ্বিতীয় মামলা—লংগদু থানা মামলা নং ৫, তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০০৭ (জিআর নং ৩৩০/২০০৭, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল নং ২৩২/২০০৮)—এর শুনানি শেষে রাঙামাটি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে আদালত বলেন, মাইকেল চাকমা অস্ত্রসহ গ্রেফতার হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে হত্যার হুমকি ও চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনা করছিল। আদালত তাকে অস্ত্র মামলায় ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং চাঁদাবাজি ও হুমকির ঘটনায় আরও ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। উভয় সাজা একত্রে কার্যকর হবে।
অপরদিকে, তার সহযোগী সুমন চাকমাকে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে এ অভিযানটি পরিচালনা করে লংগদু জোনের একটি বিশেষ টহল দল। তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মাইকেল চাকমা ও সুমন চাকমাকে অস্ত্র ও চাঁদার টাকা সহ হাতে-নাতে আটক করে। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী আসামিদের লংগদু থানায় হস্তান্তর করলে মামলা দুটি দায়ের হয়।
দীর্ঘ ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচার প্রক্রিয়া শেষে আদালত এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে। স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, এই রায় পাহাড়ে সশস্ত্র চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমনে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করবে।
স্থানীয়রা আশা প্রকাশ করেছেন, এই রায়ের মাধ্যমে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর দৌরাত্ম্য কমবে এবং লংগদু ও আশপাশের এলাকায় স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা পাবে।
মাইকেল চাকমার বিরুদ্ধে যত মামলা
অনুসন্ধানে মাইকেল চাকমার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১১টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও স্থানীয় সূত্র বলছে মাইকেল চাকমার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ২০টিরও অধিক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৭ সালে ৩০ অক্টোবর রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু থানায় মো. দুলাল উদ্দিনের করা (মামলা নং-০৪) মামলার ১ নম্বর আসামি মাইকেল চাকমা এবং তার সহযোগীরা মিলে বাদি এবং অন্য জেলেদের বেদম মারধর করে সাথে থাকা টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং নিয়মিত হারে চাঁদা দেয়ার জন্য হুমকি দেয়। পরবর্তীতে, সেনা অভিযান পরিচালনা করে মাইকেল চাকমাকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদসহ গ্রেফতার করা হয়।
২০১৮ সালে রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু থানায় রঞ্জন চাকমাকে (২৭) হত্যা করা হয়। ওই মামলাটি তার ভাই কালাবী চাকমা ১৮ জুন (এফআইআর নং ১) দায়ের করেন। ওই মামলায় মাইকেল চাকমা ১৮ নম্বর আসামি। রঞ্জন চাকমাকে দোকান থেকে ফেরার পথে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
২০০৭ সালে রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু থানার অন্তর্গত ভাইবোনছড়ায় খুন, চাঁদাবাজি এবং মারধরের ঘটনার তদন্ত অভিযানে আসামি মাইকেল চাকমাকে একটি দেশীয় অস্ত্র ও ছয় রাউন্ড গুলিসহ আটক করা হয়। ওই মামলার বাদি এএসআই মো: শরিফুল আলম এবং মামলা নং-৫। পরবর্তীতে অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিভিন্ন সরঞ্জামাদি এবং আসামিদের থানা হেফাজতে নেয়া হয়।
২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি থানায় নিরঞ্জন চাকমাসহ আরো দুইজনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন মাইকেল চাকমা। মামলাটি নিরঞ্জন চাকমার স্ত্রী মিনা ঢাকমা দায়ের করেন। (মামলা নং-১)। ওই বছরের ২১ জানুয়ারি দিবাগত রাতে তিনজন ব্যক্তিসহ মোট পাঁচজনকে ইউপিডিএফ ধরে নিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তিনজনের গুলিবিদ্ধ লাশ ছোট তারাবুনিয়া এলাকায় পাওয়া যায়। বাকি দু’জন অপহৃত অবস্থায় ছিলেন। ওই মামলার ১ নম্বর আসামি মাইকেল চাকমা।
২০১৮ সালে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর থানায় শক্তিমান চাকমা (৫৫) হত্যা মামলাটি তার একান্ত সহকারী রূপম দেওয়ান করেন। (মামলা নং-২) মামলায় মাইকেল চাকমাকে ৩৭ নম্বর আসামি করা হয়। ওই সময় শক্তিমান চাকমাকে মোটরসাইকেলে অফিসে যাওয়ার সময় এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করা হয়।
২০১৮ সালে নানিয়ারচর থানায় তপন জ্যোতি চাকমা (বর্মা) এবং তার সহযোগীদের হত্যা করা হয়। ৮ মে ওই মামলাটি নীতিপূর্ণ প্রকাশ অচীন চাকমা বাদি হয়ে দায়ের করেন। (মামলা নং ০৩/১১) দায়ের করা মামলায় মাইকেল চাকমা ৩১ নম্বর আসামি। নানিয়ারচর উপজেলার তৎকালীন চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্যে অংশগ্রহণের নিমিত্তে তপন জ্যোতি চাকমা (বর্মা) তার সহযোগীদের নিয়ে যাওয়ার সময় গাড়িবহরে ইউপিডিএফ (মূল) সশস্ত্র হামলা করে তাদের সদলবলে হত্যা করে।
২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সিএমপির পাহাড়তলী থানায় একটি মামলার আসামি মাইকেল চাকমা। ওই মামলা নম্বর-১০। মামলার এজাহারে অভিযুক্ত আসামি মাইকেল চাকমা। তার কাছ থেকে ১৯০ পিস ইয়াবা অবৈধভাবে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিজের কাছে রাখা হয়। ২০১১ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি সিএমপির পাহাড়তলী থানার এফআইআর নং-৯/২৬। এই মামলায়ও আসামি মাইকেল চাকমা। মামলায় উল্লেখ করা হয়, দু’টি এলজি ও দুই রাউন্ড কার্তুজ অবৈধভাবে নিজ দখলে রাখার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
২০১৮ সালে ১৮ জুনে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি থানায় সুরেন বিকাশ চাকমা (৫৫) হত্যা মামলাটি তার স্ত্রী বাসন্তী চাকমা এবং চাচাতো ভাই অনিল বিকাশ চাকমা। (এফআইআর নং-৪) দায়ের করেন। মাইকেল চাকমা এই মামলায় চার নম্বর আসামি। সুরেন বিকাশ চাকমাকে জেএসএস (সংস্কার) সন্দেহে ঘর থেকে ধাওয়া করে রূপকারী বিলের পাশে ছড়ায় নিয়ে ইউপিডিএফ (মূল) কর্তৃক গুলি করে এবং কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাইয়ে করা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি থানায় বন কুসুম চাকমাকে (৪০) হত্যা মামলাটির আসামি মাইকেল চাকমা। মামলায় তাকে চার নম্বর আসামি করা হয়েছে। বন কুসুম চাকমার ভাতিজা নিয়ন চাকমা বাদি হয়ে মামলাটি করেন। (এফআইআর নং-১)। মামলায় উল্লেখ করা হয়, বন কুসুম চাকমা জমিতে চাষ করা অবস্থায় জেএসএস (সংস্কার) সন্দেহে, ইউপিডিএফ (মূল) কর্তৃক মাথায় ও শরীরে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৮ সালের ২৪ আগস্ট রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি থানায় মিশন চাকমা (২৮) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মাইকেল চাকমা জড়িত থাকায় তাকে তিন নম্বর আসামি করা হয়।
মামলাটি দায়ের করেন নিহত মিশন চাকমার চাচাতো ভাই চয়ন চাকমা। (এফআইআর নং-৩) এফআইআরে উল্লেখ করা হয়, মিশন চাকমা দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে জেএসএস (সংস্কার) সন্দেহে, ইউপিডিএফ (মূল) কর্তৃক অস্ত্রের বাট, গাছের ডাল দিয়ে মাথা, ঘাড় এবং শরীরে স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত করে ধানী জমির পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।