করোনা মহামারি দূর্যোগকালীন সময়ে সাধারন মানুষদের নির্ভরতার প্রতিক হয়ে কাজ করছে সেনাবাহিনী - Southeast Asia Journal

করোনা মহামারি দূর্যোগকালীন সময়ে সাধারন মানুষদের নির্ভরতার প্রতিক হয়ে কাজ করছে সেনাবাহিনী

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মোঃ সাইফুল ইসলাম

সারাবিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়া প্রানঘাতি নভেল করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) নিয়ন্ত্রনের সর্বাত্নক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশে এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগে থেকেই দেশের সব স্থল বন্দর, নৌ-বন্দর, বিমান বন্দরসহ দেশের স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে সতর্কতা জারি করা হয়েছিলো। এর বাইরে দেশে এর সংক্রমণ শুরুর থেকেই মোকাবেলা করার জন্য দেশজুড়ে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত, সাবান দিয়ে হাত ধোয়াসহ নানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেশবাসীকে অনুরোধ জানায় দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ। এছাড়া দেশজুড়ে সাধারণ ছুটি ঘোষনার সাথে সাথে দেশের অসহায়, কর্মহীন ও দুঃস্থদের মুখে খাবার তুলে দিতে অদ্যাবধি প্রায় দেড়কোটি পরিবারকে ত্রাণের আওতায় এনেছে সরকার। এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে সুস্থ রাখতে ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধা হিসেবে সংক্রমণ এড়াতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছে; তবে অতীতের মত নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে নয়, এবার একটি যুদ্ধ জয় করে দেশবাসীকে নিরাপদ রাখতে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। মহামারি করোনাকে একটি যুদ্ধের সাথে তুলনা করে সেনাপ্রধান সেদিন সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন সর্বাত্নক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামার। এরপর থেকেই এ পর্যন্ত করোনার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সেনা সদস্যরা।

ছবি-১: পথচারীদের হাত ধোয়ায় অভ্যস্ত করতে সড়কে সেনাবাহিনীর হাত ধোয়ার বেসিন স্থাপন
ছবি-২: পাহাড়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে সেনা সদস্যরা

প্রথম ধাপে শুরুর দিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাজপথে দেশের সাধারণ জনগণকে ঘরে ফেরাতে কাজ করা শুরু করে। রাস্তায় রাস্তায় হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করে, মাস্ক ও সাবান তুলে দিয়ে করোনা প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করে, প্লেকার্ড হাতে করোনার সংক্রমণ এড়াতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বোঝানোর মতো কাজ করে যায় সেনাবাহিনী। দ্বিতীয় ধাপে এসে সেনাপ্রধানের নির্দেশে সেনাসদস্যরা করোনা মোকাবেলায় কিছুটা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। নিজেদের বেতনের একদিনের সমপরিমান অর্থ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে প্রদান করেই ক্ষান্ত থাকেনি সেনা সদস্যরা, নিজেদের রেশনের চাল, ডাল, আটা, আলু প্রভৃতি বাঁচিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ের আনাছে-কানাছে পাহাড়ী সম্প্রদায়ের মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় সেনাবাহিনী। রোদে পুড়ে-বৃষ্টিতে ভিজে, ঘূর্নিঝড় উপেক্ষা করে পাহাড়ী টিলা-ছড়া পেরিয়ে প্রতিটি ঘরে ত্রাণ সহায়তা ‍নিশ্চিত করে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশন।

ছবি-৩: হাম আক্রান্ত ৫উপজাতি শিশুকে চমেকে নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী

মাঝে রাঙামাটির সাজেক, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, সদরের ভাইবোন ছড়া, মাটিরাঙ্গা ও বান্দরবানের লামা-আলীকদমে দেখা দিয়েছিলো আরেক মহামারী হামের প্রাদুর্ভাব। সারাদেশ যখন করোনা সামলাতে ব্যস্ত ঠিক তখনি সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশন ও চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার (জিওসি) মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমানের নির্দেশে করোনার সাথে সাথে পাহাড়জুড়ে হাম নিয়ন্ত্রনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনাবাহিনীর অকুতোভয় সৈনিকরা। বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিমের চিকিৎসা সহায়তা ক্যাম্প পরিচালনা, খাগড়াছড়ি রিজিয়নের উদ্যোগে ২দিন ধরে পায়ে হেঁটে হাম আক্রান্ত দুর্গম পাহাড়ে পুষ্টিকর খাবার ও বিশুদ্ধ খাবার পানি পৌঁছে দেয়া, এমনকি নিজস্ব হেলিকপ্টারে করে হাম আক্রান্ত মুমূর্ষ ৫ শিশুকে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে গিয়ে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলার মতো উচ্চ মানসিকতা দেখায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

ছবি-৪: প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে শস্য বীজ বিতরণ করছে সেনা সদস্যরা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক করোনা পরবর্তী খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করা হলে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। তারই নির্দেশনায় সেসময় সেনা সদস্যরা দেশজুড়ে কৃষকদের মাঝে বিভিন্ন সবজি বীজ ও সার বিতরণ শুরু করেন। দেশের জনগণকে বোঝাতে শুরু করেন, দেশের প্রতিটি ইঞ্চি অনাবাদি জমিকে ফসলে ফসলে ভরিয়ে তুলতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন করে অভিনব এক বাজার চালু করে সেনাবাহিনী। ২৪ পদাতিক ডিভিশনের নির্দেশে অধীনস্থ রিজিয়নগুলো তাদের আওতাধীন এলাকাগুলোতে চালু করে এক মিনিটের বাজার। নামে বাজার হলেও সম্পূর্ন স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে সেখান থেকে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় শাক-সবজি ও তরকারীসহ ত্রান সহায়তা বিতরণ করা হয় অসহায় ও দুঃস্থদের মাঝে। এক মিনিটের বাজার থেকে বিনামূল্যে সবাই প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে গেলেও সেখানে বিতরণকৃত শাক-সবজি, তরকারী, ফলমূল মূলত সেনাসদস্যরা পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে অসহায় কৃষকদের কাছ থেকেই ন্যায্যমূল্যেই সংগ্রহ করে। ইতিপূর্বে পাহাড়ের প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রি, পরিবহণ ও বাজারজাত করা নিয়ে বিপাকে পড়েছিলো কৃষকরা। এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের মতো সেসময় সেনাবাহিনী যেমন অসহায় কৃষকের পন্য মাঠ থেকে সরাসরি ন্যায্যমূল্যে সংগ্রহ করেছে তেমনি এক মিনিটের বাজারের মাধ্যমে তা অসহায় ও কর্মহীনদের মাঝে বিতরণ করেছে। এছাড়া করোনা সংক্রমনের মাঝেই একমাস রমজান শেষে ঈদের আগে এম মিনিটের বাজারের পাশাপাশি পাহাড়ে অসহায়দের মাঝে শাড়ি, লুঙ্গিসহ কাপড়-চোপড়ও বিতরন করে সেনা সদস্যরা।

ছবি-৫: পাহাড়ে সেনাবাহিনীর এক মিনিটের বাজার

এদিকে বর্তমানে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের প্রায় ৩ মাস পার হতে চলেছে। এমতাবস্থায় দেশজুড়ে করোনা মোকাবেলায় প্রতিনিয়ত কাজ করার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাতেই নতুন করে এক অভিনব উদ্যোগ হাতে নিয়েছে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশন। ইতিমধ্যেই এ উদ্যোগের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। করোনার এই ক্রান্তিকালে সারাদেশেই যখন করোনা রোগীদের পাশাপাশি সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা না পাওয়ার অহরহ অভিযোগ উঠেছে, ঠিক তখনি পাহাড়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের ডাক্তাররা আয়োজন করেছেন নতুন চিকিৎসা সেবা ক্যাম্পের, যেখানে পাহাড়ের পাহাড়ী-বাঙ্গালী গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, চিকিৎসা সেবা, প্রয়োজনীয় ঔষধের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবারও বিতরণ করছে সেনাবাহিনী।

ছবি-৬: করোনা সংকটে গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে সেনাবাহিনী

গত ১৪ জুন খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়নের উদ্যোগে দীঘিনালা উপজেলার দুর্গম পাবলাখালী এলাকায় জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হয়। এর পাশাপাশি গত ১০ জুন বুধবার জেলার পানছড়িতে একটি চিকিৎসা সেবা ক্যাম্প পরিচালনা করে সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি রিজিয়ন, যেখানে গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, চিকিৎসা সেবা, প্রয়োজনীয় ঔষধের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবারও বিতরণ করেছে সেনা সদস্যরা। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর বান্দরবান রিজিয়নের উদ্যোগে গত ১০ জুন বুধবার, ১৪ জুন রবিবার ও ১৭ জুন বুধবার জেলার বিভিন্ন স্থানে গর্ভবতী নারীদের জন্য মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়া হয়। একই ভাবে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতেও।

এছাড়া করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়ারচরে দেশখ্যাত সুমিষ্ট আনারসের বাম্পার ফলন হলেও পরিবহণ সুবিধা, বাজারজাতসহ আনারস বিক্রি নিয়ে বিপাকে পড়া চাষীদের পাশে দাঁড়িয়েছে সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধানের নির্দেশনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার অংশ হিসেবে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও এরিয়া কমান্ডার নানিয়ারচরের প্রান্তিক চাষীদের নিকট থেকে ন্যায্য মূল্যে সবজি কেনার পাশাপাশি মৌসুমী ফল আনারস ক্রয় করে দরিদ্র চাষীদের সহায়তার ব্যবস্থা করে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। আনারস বিক্রয় ও পরিবহণজনিত জটিল সমস্যার কথা জানামাত্র তা সমাধানের জন্য আনারস চাষী ও ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ায় ২৪ পদাতিক ডিভিশনের সেনা সদস্যরা। গত ১৪ জুন রবিবার নানিয়ারচরের দুর্গম পাহাড়ি এলাকার বিভিন্ন আনারস বাগান থেকে নগদ মূল্যে আনারস ক্রয় করে নানিয়ারচর জোনের তত্ত্বাবধানে ট্রাকযোগে নিয়মিত চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে প্রান্তিক চাষীরা বাগান থেকে ন্যায্যমূল্যে আনারস বিক্রয় করার কারণে পরিবহন ভাড়া বাঁচিয়ে অধিক লাভবান হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর এই মহৎ উদ্যোগে নানিয়ারচরের দরিদ্র আনারস চাষীরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ।

এমনিভাবে করোনার এই দূর্যোগকালীন সময়ে সেনাবাহিনী প্রকৃতপক্ষেই সাধারন মানুষের পরম বন্ধু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সকল কাজে পেশাদারিত্ব আর পরিকল্পনার ছাপ থাকায় সাধারণ মানুষ খুবই উপকৃত হচ্ছে।